হালিমা খাতুন রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা। তার পেশীতে মৃদু ব্যথা, গলায় খুসখুস ভাব এবং শুকনো কাশি ছিল। কখনো তেমন বাড়েনি শরীরের তাপমাত্রা। তাই এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই দিনে দুই বেলা প্যারাসিটামল খেয়েছেন। তবে পঞ্চম দিনের মাথায় তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে ও মেয়ের শরীরে একই ধরনের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিজের করোনা টেস্ট করান। এতে পজিটিভ রিপোর্ট আসে। পরে দুই সন্তানের নমুনা পরীক্ষা করিয়েও একই ফল পাওয়া যায়। সম্প্রতি তার বাসার গৃহপরিচারিকারও শুকনো কাশি শুরু হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকরা বলছেন, সংক্রমণের বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে উপসর্গহীন ব্যক্তিরাই। তাদের হাঁচি-কাশি থেকেও করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে। কিন্তু পাশের মানুষটি তা জানেন না, কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেন না। জোরালো উপসর্গ না থাকায় আক্রান্ত ব্যক্তিও সহজে নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। ফলে মৃদু উপসর্গ থাকা এসব রোগীর মাধ্যমে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীর পাশাপাশি পথঘাট-বাজার-গণপরিবহণে অপরিচিতজনদের মধ্যে ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস।
অধ্যাপক আহমেদুল কবীর, যিনি বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব জানান, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা বিশেষ শারীরবৃত্তিয় কারণে অনেকের শরীরে সব রোগের উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। ভেতরে রোগ থাকে, কিন্তু বাইরে প্রকাশ পায় না। কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও তা সত্যি। উপসর্গহীন মানুষ সবার সঙ্গে সবার মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা রোগ ছড়ায়; এখন করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে \’অ্যাসিম্পটোমেটিক\’। উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে আক্রান্তদের চারটি ভাগে ভাগ করা যায় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আহমেদুল কবীর। প্রথমে আছে অ্যাসিম্পটোমেটিক বা উপসর্গহীন। দ্বিতীয় পর্যায়ে \’প্রাক-উপসর্গ\’। এই পর্যায়টিকে সবচেয়ে মারাত্মক বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এটি উপসর্গ দেখা দেওয়ার পূর্ববর্তী ৪৮ ঘণ্টায় আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এরপর উপসর্গকাল। আক্রান্ত ব্যক্তির এই সময় জ্বর, কাশি, ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এর পরের স্তরে নিউমোনিয়া দেখা দেয়। পাশাপাশি তীব্র শ্বাসজনিত সমস্যা তৈরি হয়। কখনো কিডনিসহ অন্য কিছু অঙ্গ কার্যকারিতা হারায়।
কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, গত দুই সপ্তাহে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের একটি বড় অংশের সংক্রমিত হওয়ার ইতিহাস একই রকম। মৃদু উপসর্গ থাকা পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী কিংবা সহপাঠীর সংস্পর্শে গিয়ে তারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। নিজেদের শরীরেও প্রাথমিকভাবে মৃদু উপসর্গ থাকায় তারা নিজেরাও বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি। নমুনা পরীক্ষার আগে তারাও নিজেরা সতর্ক না থাকায় তাদের মাধ্যমেও অনেকে সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানান তারা। জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, রোগতাত্ত্বিক জরিপ করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটি পরিস্থিতি জানার জন্য দরকার। এটা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্যও দরকার। একাধিক গবেষণা ও জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তারা বলেন, কোনো দেশে ৬৪ শতাংশ, কোনো দেশে ৩০ শতাংশ উপসর্গহীন সংক্রমিত ধরা পড়েছে। সেই পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। অথচ দেশে করোনা মহামারির প্রকোপ প্রায় দুই বছর হতে চললেও এখনো এ ধরনের জরিপ করা হয়নি। ফলে রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি তৈরিতে বরাবরই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা সম্পন্ন নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের উপসর্গ অনেকটাই মৃদু। সাধারণ ঠান্ডা লাগার ভাইরাসের জিন ওমিক্রনে প্রবেশ করার কারণে এটি আগ্রাসনে একেবারেই সাধারণ, মোটেও ডেল্টা বা উহানের আদি ভাইরাসটির মতো নয়। ঠান্ডা লাগা বা ফ্লু ধরনের লক্ষ্যণে গা ব্যথা, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা থাকছে। ডেল্টাসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের মতো শুকনো কাশি, সর্দি বা নাক বন্ধ কিংবা শ্বাসনালী সংক্রমণ থাকছে না, অক্সিজেনের দরকার হচ্ছে না, স্বাদ বা গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতাও নষ্ট হচ্ছে না। তবে সংক্রমণ বিস্তারের গাণিতিক প্রকাশ \’আর নট\’ ডেল্টার ক্ষেত্রে ১.০৯ হলেও ওমিক্রনের ক্ষেত্রে ৪। অর্থাৎ ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে চার গুণ বেশি ছড়াচ্ছে। এতে দ্রম্নত হাসপাতালে রোগীর চাপ ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। ওমিক্রন যেহেতু ফুসফুস আক্রমণ করছে না, সাধারণ ঠান্ডার মতো গলা পর্যন্ত সংক্রমণ ঘটিয়ে থেমে যাচ্ছে, সে কারণে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাধিক্য হলে তাদের অবস্থান স্বল্পমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মৃদু উপসর্গের রোগীরা করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই তাদের দ্রম্নত চিহ্নিত করা জরুরি। আর এ জন্য নমুনা পরীক্ষা কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। করোনার যেকোনো উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্র সাধারণ মানুষ যাতে সহজেই নমুনা পরীক্ষা করতে পারে, সে সুযোগ তৈরির ওপরও গুরুত্ব দেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, \’করোনা পরীক্ষার প্রয়োজনীতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। সবার পরীক্ষা বিনামূল্যে করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আরও বেশি পরীক্ষা ছাড়া আমরা মহামারিটি মোকাবিলা করতে পারব না। এটি আরও দীর্ঘায়িত হবে।\’ এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত দুই বছরে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার ল্যাবের সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়লেও সে তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। দেশে গত সপ্তাহ তিনেক ধরে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেও নমুনা পরীক্ষার হার অনেকটা আগের মতোই রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পরীক্ষা করাতে মানুষের অনাগ্রহই পরীক্ষা কমার মূল কারণ। এর জন্য তারা দায়ী করেছেন সরকারের সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাবকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, মানুষ পরীক্ষা করাতে না যাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে লক্ষ্যণবিহীন সংক্রমণ। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশিদ আলম বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে। \’তবে মানুষ যদি পরীক্ষা করাতে না আসে তাহলে আমরা কী করতে পারি? মহামারি মোকাবিলা করা শুধুমাত্র একটি মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। বরং এর জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।\’ প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার ও ৯৮টি বেসরকারি পরীক্ষারে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৫৭টি পরীক্ষাগারে জিন এক্সপার্ট এবং ৬৪৬টি পরীক্ষাগারের্ যাপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে টেস্ট করানো হচ্ছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দেশে সর্বমোট চলমান পরীক্ষাগারের সংখ্যা ৮৫৭টি। অথচ এসব পরীক্ষাগারে করোনার ভয়াবহ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেও গড়ে ৩৩-৩৪ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি।
সংবাদ সূত্রঃ যায়যায়দিন