মান সনদ জালিয়াতি: ৫০ কনটেইনার বিটুমিন জব্দ

জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া সনদ জমা দিয়ে আমদানিকৃত বিটুমিনের একটি চালান চট্টগ্রাম কাস্টমসের হাতে ধরা পড়েছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকার ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’।

প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ টন বিটুমিনের চালান ছাড়ের জন্য ভুয়া মান সনদ তৈরি করে চট্টগ্রাম কাস্টমসে জমা দেয়। ৭২ লাখ টাকার শুল্ক পরিশোধ করে ৫০ কনটেইনারের মধ্যে ৯ কনটেইনার বিটুমিন গতকাল ছাড়ও করে নিয়েছে। এরই মধ্যে অভিযোগ পেয়ে সনদ যাচাই করতে গিয়ে জালিয়াতি ধরা পড়ে; এরপরই ৫০ কনটেইনারের পুরো চালানটি আটক করে কাস্টমস। ছাড় হওয়া বিটুমিনভর্তি কনটেইনারগুলো বন্দরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে কাস্টমস। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা বলেন, ‘অর্থবছর শেষ হতে সময় মাত্র তিন দিন। আমরা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে দিন পার করছি। ঠিক এই সময়টাই বেছে নিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সিঅ্যান্ডএফ সান শাইন এজেন্সি। ’

তিনি আরও বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির মান সনদ এমন সূক্ষ্মভাবে জালিয়াতি করা হয়েছে; সাদা চোখে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। এই সুযোগে আজই (গতকাল) বিটুমিনভর্তি ৯টি কনটেইনার ছাড় হয়েছে। আমি সরেজমিনে গিয়ে যাচাই করে ছাড় হওয়া কনটেইনার পুনরায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যে ফেরত আসবে।

কোনো প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি ধরা পড়ার পর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, মান সনদ উত্তীর্ণ না হয়ে পণ্যছাড় করা অপরাধ। সেই সঙ্গে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সনদ জালিয়াতি করে জমা দেওয়া আরও কঠোর অপরাধ। আমরা প্রথমে ছাড় হওয়া পণ্য ফেরত নিয়ে আসছি। এরপর আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে শোকজ করব। এরপর আইনগত কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করব। কোনো ছাড় হবে না।

উল্লেখ্য, দেশে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিন ধরে এসব বিটুমিন আমদানি হলেও মান নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে অহরহ নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি হচ্ছিল; কোনোভাবেই সেটি ঠেকানো যাচ্ছিল না। এতে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে হাজার কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছিল সরকারের। সর্বশেষ গত ২৫ মে বিটুমিনের মান নিশ্চিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিনটি নির্ধারিত ল্যাবে মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে। এরপর থেকেই মূলত নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির চক্রটি বিপাকে পড়ে। মান যাচাই বাধ্যতামূলক করার পর এই প্রথম কোনো চালান ধরা পড়ল চট্টগ্রাম কাস্টমসের হাতে।

নমুনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে আমদানিকারক ঢাকার ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ ভুয়া মান সনদ কাস্টমসে জমা দিয়ে বিটুমিন চালান ছাড় নিতে চেয়েছিল। ৫০ কনটেইনারের মধ্যে ৯টি কনটেইনার ভুয়া সনদ দিয়ে বন্দর থেকে খালাস পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের হাত থেকে শেষ রক্ষা হলো না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’-এনডিই এর একটি বাণিজ্যিক চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে ১৪ জুন। এই চালানে ৫০টি কনটেইনারে মোট প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন বিটুমিন ছিল। চালানটির মূল্য ছিল ৪ লাখ ১৭ হাজার মার্কিন ডলার। ইরানের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি নেগার’ থেকে নামিয়ে গত ২০ জুন বিটুমিনের চালানটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনাটি পাঠানো হয় সরকারি ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল)। ইআরএল গত ২৪ জুন পণ্যের মান সনদ দেয়।

রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আটটি শ্রেণিতে চালানটির মান পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু দুটি শ্রেণিতে চালানটির মান উত্তীর্ণ হয়নি। মান উত্তীর্ণ না হওয়ায় চালানটি বন্দর থেকে ছাড় করার কোনো সুযোগ ছিল না। এই কারণে ইস্টার্ন রিফাইনারির মূল সনদ কাস্টমসে জমা না দিয়ে জালিয়াতি করে ভুয়া সনদ দিয়ে কাস্টমস থেকে পণ্য বের করার কৌশল নেয় আমদানিকারক ও চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ সান শাইন এজেন্সি।

জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সান শাইন এজেন্সির মালিক মাহমুদ রেজা বলেন, আমরা ওই আমদানিকারকের কাজ মাঝে মধ্যে করি। ভুয়া সনদ দিয়ে পণ্য ছাড়ের বিষয়টি আমার জানা নাই। পরে অসুস্থতার অজুহাতে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি। ৯টি কনটেইনার ফেরতের বিষয়ে কাস্টমসের নির্দেশ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে চান। এরপর উল্লিখিত বিষয়ে ফোনে বক্তব্য চাইলে তিনি আর কথা বলেননি।

জানতে চাইলে মান সনদ দেওয়া প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির উপ-মহাব্যবস্থাপক (মান নিয়ন্ত্রণ) জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আজ (সোমবার) বিকালে কাস্টমস থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হয়েছে জালিয়াতির বিষয়টি। আমি আসল সনদ কোনটি সেটি তাদেরকে নিশ্চিত করেছি। ’

তিনি আরও বলেন, নমুনা পরীক্ষায় ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’-এর চালানটি মান উত্তীর্ণ হয়নি। দুটি শ্রেণিতে চালানটি মান উত্তীর্ণ হয়নি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পেনিট্রেশনে সেটি ৭২ পয়েন্ট পেয়েছে। কিন্তু চালানটি ৬০-৭০ গ্রেডের মধ্যে থাকতে হবে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসে গত বছর এই ধরনের বেশ কিছু মান সনদ জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ম্যানুয়ালি এবং মেইলে দুই ভাবে মান সনদ কাস্টমসে পাঠানোর নিয়ম আছে। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি কেন জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে তো আমদানিকারকের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সিলগালা করা নমুনা পাঠান এবং মান সনদও সিলগালা করে নিয়ে যান কাস্টমসে। এক্ষেত্রে বাহক কিন্তু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। এখন কাস্টমস যদি ই-মেইলে মান সনদ চায় তাহলে তো আমরা দিতে পারি। তাহলে জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে।

Scroll to Top