বিএনপির চেয়ারপার্সন ও দলনেত্রী খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এফএম সিদ্দিকী বলেছেন, খালেদা জিয়া স্টাবল থাকলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাননি। আমরা বলেছি তিনি স্টাবল আছেন।
যখন আমরা কোনো রোগীকে বলি তিনি স্টাবল আছেন, তখন বুঝতে হবে যে তার যে আসল অসুখ সেই অসুখটা একটা স্থিতি অবস্থায় এসেছে। উনি কিওর হয়ে যাননি।
গতকাল শনিবার(১৯জুন) রাত সাড়ে ৯টার দিকে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে রাত ৮টার দিকে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়াকে গুলশানে বাসায় নিয়ে আসা হয়।
তিনি বলেন, আমরা যেদিন রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাই সেদিন সিটি স্ক্যানসহ সমস্ত পরিক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা দেখতে পাই যে ওনার বুকে পানি এসেছে সেটা হার্ট ফেইলিওয়র সংক্রান্ত। করোনার একটা জটিলতা হচ্ছে যে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। প্রথম তিন দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর ওনার অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেও তারপরেই করোনার সবচেয়ে মারাত্মক যে অবস্থা, সাইটোকম স্টোম সেই সাইটোকম স্টোম যখন শুরু হলো, উনি জ্বরে আবার আক্রান্ত হলেন। ওনার দুই দিকের বুকে পানি আসলো এবং হার্টের যে পেরিপাইডিয়াল কেভিটি সেখানে পানি আসলো। পানিটা আসতে শুরু করলো বন্যার স্রোতের মতো এবং একদিনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হয়ে অক্সিজেন সেচুরেশন ফল করলো। আমরা দ্রুত ওই সময় তাকে পরীক্ষা করে দেখলাম, বুকের দু’দিকে অর্ধেক বুকে পানি চলে এসেছে অক্সিজেন কমে গেছে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। ওই অবস্থায় আমরা ওনাকে সিসিইউতে নিয়ে যাই।
ডা. সিদ্দিকী বলেন, তিন তারিখে (৩মে) সিসিইউতে নিয়ে আর্জেন্ট এক্সরে ও আল্ট্রাসনো করে দেখা গেলো উনার অর্ধেক বুক পানিতে ভরে গেছে এবং লাঞ্চ কম্প্রেস করে যাচ্ছে। তখন আমরা ওনাকে চেস্ট টিউব দিয়ে পানি বের করার পদ্ধতিতে যাই। দেখা গেল সেটা আসলে পানি না, স্রোতের মতো রক্ত আসছে। সেই রক্ত প্রথমে বাম দিকে তারপরে ডান দিকে টিউব দিয়ে আসতে শুরু করল। সেই টিউব দিয়ে উনাকে ইমিডিয়েট রেস্ক্যু করার পরেও সেই পানি আসছিল। প্রায় উনিশ দিন ওনার দুই পাশের চেস্ট টিউবে পানি ছিল।
দুই পাশে দুটি ব্যাগ ছিল, যে ব্যাগে সারাক্ষণ পানি আসছিল। সবচেয়ে যেটা ভয়ের ব্যাপার ছিল অনেকগুলো ব্লাড রিপোর্টে দেখাচ্ছিল উনি খুব সিরিয়াস সাইটোকম স্টোমে আছেন। একটা সময় আমাদের মনে হচ্ছিল যে ওনাকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টও দিতে হতে পারে। সেজন্য আমরা ওনার পরিবারের সদস্য ও দলীয় সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়েছিলাম। তারপরে ১৯দিনে প্রায় সাত লিটারের ওপরে হেমোরেজিং ফ্লুইড ও পানি এসেছে। আমাদের দেশে যত রকম ব্যবস্থা আছে তা করে প্রথমে বাম দিক তারপরে খুব সাকসেসফুললি ট্রিট করে বাম দিকের টিউবটা সরাতে সক্ষম হয়েছি। পানির যে কন্টিনিউয়াস আসা সেটা বন্ধ করতে পেরেছি। ওই পরীক্ষার সময় আমরা দেখতে পেরেছি আসলে সাইটোকম স্টোমের সঙ্গে হার্ট ফেইলিওর, হার্ট ফেইলিওরের সঙ্গে কিডনির সমস্যা ছিল। লিভার ডি কম্পেটেনেন্ট ছিল। যার জন্য ওনার লিভার থেকে যে বিশেষ অ্যালবুমিন সেচুয়েটেড হয় সেটা কম হচ্ছিল। সমস্তগুলো বিষয় একসঙ্গে কমফাউন্ডেড হয়ে ওনার এরকম একটা সিরিয়াস অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন। তারপর দ্রুত সিদ্ধান্তগুলো নেই, ম্যাডামের যে ব্যক্তিগত চিকিৎসক টিম, তার সঙ্গে এভারকেয়ার হাসপাতালের একটা সুদক্ষ টিম। আরও ছিল আমেরিকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ইংল্যান্ডে ওনার পুত্রবধু ডা. জোবাইদা। আমরা টোটাল একটা টিম ওয়ার্ক হিসেবে কাজ করেছি। প্রতিদিন আমরা যারা এখানে বিশেষজ্ঞ ছিলাম, স্বাস্থ্য রিভিউ করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যখন সাকসেসফুললি ওনার টিউব সরাতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, বলা যায় ওনার কোভিড এবং কোভিড পরবর্তী যতগুলো জটিলতা ছিল সেগুলো সাকসেসফুললি কন্ট্রোল করেছি। কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি যে ওনার কতগুলো ডিজিজ যেমন আথ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, প্রেসার, হাইপারটেনশন সেগুলোর চাইতেও উনি ভেতরে ভেতরে কতগুলো অসুখে আক্রান্ত ছিলেন। যেগুলো কখনো পরীক্ষাও হয়নি, বিশেষ করে গত তিন চার বছর। কোভিডের কম্প্লিকেশনের পরে সেটা বের হয়ে আসছে। যখন তাকে সিসিইউ থেকে কেবিনে সিফট করেছি কয়েকদিন আগে। কেবিনে আসার পরে আবার দেখলাম উনি হসপিটালের ইনফেকশনে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। তখন ওনার ব্লাড কালচার করে দেখা যাচ্ছে যে হসপিটালে যে সমস্ত জীবাণু থাকে সেগুলো ম্যাডামকে আক্রমণ করছে। উনি এভারকেয়ার হাসপাতালের গ্রিন জোনে নন কোভিড এরিয়ায় ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং পরিষ্কারভাবে মেডিক্যাল বোর্ডের যে সিদ্ধান্ত দিয়েছি। আমরা একটা লেভেল পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে কতগুলো জটিলতা কন্ট্রোল করতে পেরেছি। কিন্তু কতগুলো বিষয় আছে যেমন ওনার যে লিভারে সমস্যা যেটা ধরতে পেরেছি, সেটা কোন স্টেজে আছে, এমন সব সেন্ট্রারে এগুলো অ্যাসেসমেন্ট হওয়া উচিত যেখানে আর্ট্রিফিসিয়াল লিভার সাপোর্ট দেয়, অন্যান্য অ্যাডভান্স টেকনোলজি অ্যাপলাই করতে পারে। কারণ লিভারের অসুস্থতা শুধু লিভারে থাকে না, খাদ্যনালীতে হয়, যেটা সমস্ত শরীরে প্রভাব পড়ে। পেটে পানি আসে। মেজর কতগুলো কম্প্লিকেশন সেই ধরনের টেকনোলজি ও ট্রিটমেন্ট সাপোর্ট আমাদের বাংলাদেশে নেই বলে আমরা মনে করি। সেজন্য টোটাল বোর্ডের ডিসিশন আমরা লিখিত আকারে লিখে দিয়ে আসছি। আপনারাও জানতে পারবেন।
আপনি বললেন অনেকগুলো কম্প্লিকেশন সেগুলো কি বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাব ডা. সিদ্দিকী বলেন, আমরা বলেছি তিনি স্টাবল। যখন আমরা কোনো রোগীকে বলি তিনি স্টাবল আছেন, তখন বুঝতে হবে যে ওনার যে আসল অসুখ সেই অসুখটা একটা স্থিতি অবস্থায় এসেছে। উনি কিওর হয়ে যাননি। সেরকম যদি হতো তাহলে আমরা বলতাম যে উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাসায় এসেছেন। আমরা বলছি যে উনি স্টাবল আছেন, মানে হলো উনার যে হার্ট, কিডনি লিভারের জটিলতা, সেগুলো কোভিডের কারণে যে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটেছে। কিন্তু সেই অসুস্থতাগুলো রয়েই গেছে।
এখন আমরা প্লান করেছি এখানে বাসায় রাখবো, উনি অবজারবেশনে আছেন, কিন্তু ওনাকে ২ অথবা ৩ সপ্তাহ পরে হয়তো আবার আমাদেরকে অপশন রাখতে হচ্ছে হসপিটালে নিয়ে রিভিউ করতে হতে পারে।
আপনি কি মনে করেন উনাকে বিদেশে নেওয়া জরুরি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি ওনার যে লিভারের কন্ডিশন। আপনারা জানেন হার্টের ট্রিটমেন্টের আমাদের দেশে একটা অ্যাডভান্টেজ আছে কিন্তু কিডনি ট্রিটমেন্টে জন্য তেমন নেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আপাতত করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসা শেষ করে বাসায় ফিরেছেন আলহামদুলিল্লাহ আমরা শুকরিয়া আদায় করি।
এসময় উপস্থিত ছিলেন ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন, ডা. মামুন, চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ও শামসুদ্দিন দিদার প্রমুখ।