তোপের মুখে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা; যা লিখলো টেলিগ্রাফ

বাংলাদেশে বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদের মধ্যে বিরোধ পূর্ণাঙ্গ সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সে বিষয়টি পুনরুল্লেখ করায় তার তীব্র সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে ওই সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ২২ শে আগস্ট ভারতের অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক দেবাদীপ পুরোহিত।

‘জাজ ফেসেস হাসিনাজ আয়্যার- চিফ জাস্টিসেস শরীফ রেফারেন্স স্পার্কস আউস্টার কলস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি আরো লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়েছেন তার সমর্থকরা। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের সংগঠনের এক মিটিংয়ের পরে দ্য টেলিগ্রাফকে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শ.ম. রেজাউল করিম বলেছেন, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। তা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হুমকি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে হবে।

রিপোর্টে আরো লেখা হয়েছে, সন্ধ্যার দিকে ঢাকা থেকে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছেন যে, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগ অথবা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। রেজাউল করিম জানান, আদালতের ক্ষমতার বিষয়ে শুনানিতে ( সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী) প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানে নওয়াজ শরীফকে বরখাস্তের প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাই তার ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়াতে দল ধারাবাহিক প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে যাবে। সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের একটি সিদ্ধান্ত। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হয় ওই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। ওই সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দেয়ার প্রস্তাব ছিল। রাজনৈতিক বিষয়ে এই রায়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। এটা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
ওই রায় হওয়ার পরে প্রকাশ্যে বিচারপতি সিনহার সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।

সুপ্রিম কোর্টের সূত্র বলেছেন, কেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উদ্ধৃত করেছেন প্রধান বিচারপতি তা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন প্রধান বিচারপতি। কিন্তু তাতেও সেই অবস্থার উন্নতি হয় নি। একটি মামলার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বিচার বিভাগ অত্যন্ত ধৈর্য ধরেছে। আমরা অনেক ধৈর্য ধরছি। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট (সেখানকার) প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছে। তা নিয়ে কি কোনো সমালোচনা হয়েছে? না (হয় নি)। আমি যেটা বলতে চাইছি তা হলো আমাদেরকে আরো পরিপক্ব হতে হবে।

পাকিস্তানকে রেফারেন্স হিসেবে তুলে ধরায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানকে এখনও সংখাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করে। ওই দেশকে রেফারেন্সে তুলে ধরায় নীরবতা ভেঙেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। তিনি প্রধান বিচারপতির সমালোচনা শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা সব কিছু সহ্য করতে পারি। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে (বাংলাদেশকে) তুলনা? এটা মোটেও সহ্য করার মতো নয়।

প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রতিজবাবে বিরোধে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কয়েক ডজন সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে ঢাকায় গুজব ডালপালা মেলেছে। আওয়ামী লীগপন্থি শিবির থেকে বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি চলে যাওয়ার পথে রয়েছেন। বাংলাদেশে সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ৯ মাসের রক্তাক্ত স্বাধীনতা লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে এ দেশটি। এরপর গত ৪৬ বছরে এখানে কয়েকজন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে। রক্তাক্ত অভ্যুত্থান হয়েছে। সেনা শাসকরা ক্ষমতায় এসেছেন। এসেছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। ক্ষমতায় এসেছে সেনা সমর্থিত বেসামরিক সরকার।

তবে আগস্ট মাসটি নানা কারণে ব্যতিক্রমী। প্রথমত: দীর্ঘ দিন একই অবস্থানে ছিলেন সাংবিধানিক দুই শীর্ষ প্রধান শেখ হাসিনা ও বিচারপতি এসক কে সিনহা। প্রধান বিচারপতিকে তার পদে তুলে এনেছেন হাসিনা। বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের প্রথম কোনো হিন্দু প্রধান বিচারপতি বানিয়েছেন তাকে। কিন্তু পরিস্থিতি কেন এমন হলো। এর মধ্যে কি এর চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে?
দ্বিতীয়ত: ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়ার পর উত্তেজনা নিরসনে বাংলাদেশে ক্ষমতার করিডোরের বেশ কিছু নিয়ামক প্লেয়ারের ( কী প্লেয়ার) চেষ্টা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট এবং গণভবনের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। গণভবন হলো প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন।

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট (আবদুল হামিদ) ও সিনিয়র মন্ত্রীরা একটি সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। এই অবস্থায় প্রধান বিচারপতি ওই রকম একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এটা বিস্ময়কর।
শেষ পর্যন্ত, এ সঙ্কট প্রকাশ হয়েছে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের দিকে। আগামী বছর ২০১৮ সালের শেষের দিকে এ নির্বাচন হওয়ার কথা। ঢাকায় অবস্থানরত একজন কূটনীতিক বলেছেন, যা ঘটছে তা দুর্ভাগ্যজনক। এটা দেশের বিষয়গুলোকে শুধু জটিলই করবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সুবিধা পাবে শুধু বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা।

বিরোধীরা প্রায় ১১ বছর ক্ষমতার বাইরে। তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতাও দুর্বল হয়েছে। তারা উদ্ভুত পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছে সরকারকে ঘায়েল করতে, সরকার প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে পড়েছে বিব্রতকর অবস্থায়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সংশোধনের পথ পরিহার করে সরকার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের ওপর। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করার চেষ্টা করছে সরকার। এ বিষয়টি আমরা বিশ্বকে জানাবো। ওদিকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও আওয়ামী লীগপন্থি ভাষ্যকার মোহাম্মদ এ আরাফাত মনে করেন, বিএনপির এই অভিযোগ অসঙ্গত বা পরস্পরবিরোধী। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের ওপর যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণই থাকতো তাহলে এমন ভিন্নমত বেরিয়ে আসতো না।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, ২৪ আগস্ট ২০১৭,

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এস

Scroll to Top