নকল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করে বিভিন্ন ভাবে ঋণ নেওয়ার এক আধুনিক জালিয়াতির সিস্টেম চালু হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি বন্ধে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তাগিদ এবং নির্বাচন কমিশনের কঠোর অবস্থান ও শূন্য সহনশীলতা নীতি ঘোষণার পরও অপরাধীচক্র সক্রিয়। এ পর্যন্ত যেসব জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ হয়েছে, এর সব কটিতেই ‘সরষের মধ্যে ভূত’-এর সন্ধান মিলছে। জানা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ না কেউ এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে গোয়েন্দা পুলিশ মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল এনআইডি তৈরি চক্রের পাঁচজনকে আটক করেছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের দুজন কর্মীও রয়েছেন। তাঁদের দেওয়া জাল এনআইডির মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিত খেলাপিরা।
এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া শহর থেকে এম এম ওয়াদুদ নামের এক ব্যক্তির বিপুল অঙ্কের টাকার সম্পত্তি এনআইডি জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এনআইডি জালিয়াতচক্রের অন্যতম হোতা, সদ্য বিলুপ্ত কুষ্টিয়া শহর যুবলীগের আহ্বায়ক আশরাফুজ্জামান সুজনসহ আরো কয়েকজনকে।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের এনআইডি দিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ ওঠে গত বছর। এই বছরের আগস্টে এক রোহিঙ্গা নারীর এনআইডি পাওয়াকে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়। বেরিয়ে আসে লাখ টাকার বিনিময়ে কিভাবে জাল এনআইডি পায় রোহিঙ্গারা। দালালচক্রের সঙ্গে ইসির কর্মচারীর পাশাপাশি কর্মকর্তাদের নামও আসে আলোচনায়। জালিয়াতচক্রের খোঁজে মাঠে নামে ইসি, পুলিশ ও দুদক টিম। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটও সে সময় তৎপর হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের তদন্ত চলমান। এ ছাড়া জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর এনআইডি জালিয়াতির দায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সর্বশেষ ঘটনা: জাল এনআইডি তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলনে সহায়তাকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে শনিবার রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডের ডি-ব্লক এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের আটক করা হয়। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ১২টি জাল এনআইডি উদ্ধার করা হয়। আটকৃতরা হলেন সুমন পারভেজ (৪০), মজিদ (৪২), সিদ্ধার্থ শঙ্কর সূত্রধর (৩২), আনোয়ারুল ইসলাম (২৬) ও আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪১)। এর মধ্যে সিদ্ধার্থ ও আনোয়ারুল নির্বাচন কমিশন অফিসের সফটওয়্যার ব্যবহার করে সহজেই জাল এনআইডি তৈরি করতে পারতেন।
এ সম্পর্কে ডিএমপির উপকমিশনার (ডিসি) ওয়ালিদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা অবৈধ পন্থায় অনেককে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করে দিয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০-এ মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাইলে বিচারক দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এই অপকর্মে জড়িত পলাতক ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ডিবি জানায়, সিদ্ধার্থ ও আনোয়ারুল ই-জোন কম্পানির মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পেয়ে নির্বাচন কমিশনের অধীনে খিলগাঁও ও গুলশান অফিসে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের ইসির সার্ভারের একসেস দেওয়া থাকে। এ সুযোগে তাঁরা নির্বাচন কমিশন অফিসের সফটওয়্যার ব্যবহার করে সহজেই জাল এনআইডি তৈরি করতে পারতেন। তাঁরা প্রথমে ঋণ পেতে আগ্রহীদের আগের এনআইডি, বিদ্যুৎ বিল ও জন্মনিবন্ধনের কপির তথ্য দিয়ে সার্ভারে ঢুকতেন। তারপর ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিতেন। এরপর নতুন একটি নামে ওই ভুয়া এনআইডি এন্ট্রি করতেন। পরদিন সার্ভারে আপলোড করে দিতেন।
ডিবি জানায়, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেউ খেলাপি হলে আর ব্যাংকঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন না। এ রকম কিছু ঋণখেলাপিকে আটক সুমন ও মজিদ ঋণ পাইয়ে দেবেন বলে প্রথমে জাল এনআইডি তৈরির জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নিতেন। পরবর্তী সময়ে ঋণ পাস হলে মোট টাকার ১০ শতাংশ হারে তাঁদের দিতে হবে মর্মে চুক্তি করতেন। চুক্তিতে রাজি হলে তাঁরা প্রথমে এনআইডি তৈরির কাজটি করতেন।
ডিবির তথ্য মতে, এসব জাল এনআইডিধারী বেশির ভাগের পেশা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাঁরা জালিয়াতচক্রের তৈরি করে দেওয়া অর্ধশত জাল এনআইডি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে ১০ লাখ থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত তুলে নিয়েছেন।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার মামুন এর আগে একাধিক ব্যাংকে চাকরি করেছেন। তিনি এরই মধ্যে দুটি ব্যাংক থেকে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। পরে শনিবার রাতে আরেকটি নকল জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার জন্য মিরপুর গেলে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে তিনি গ্রেপ্তার হন। দুই বছর ধরে চক্রটি এই জালিয়াতি চালিয়ে যাচ্ছিল বলে স্বীকার করেছে। সুমন ও মজিদ বিভিন্নজনের কাছ থেকে জালিয়াতি কাজের অর্ডার নিয়ে তা সিদ্ধার্থ ও আনোয়ারুলকে দিয়ে করিয়ে দিতেন।
চক্রের অন্যতম হোতা সুমন পারভেজ ও মজিদ জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, মো. মিল্টন নামে পলাতক এক ব্যক্তি জাল এনআইডি তৈরি করে নর্থ সাউথ রোডের একটি ব্যাংক থেকে তিন কোটি টাকা, ইয়াছির নামে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি প্রগতি সরণির একটি ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা, সালেহ আহম্মেদ নামে একজন গুলশানের একটি ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং মো. আবদুল মজিদ নামে আরেকজন জাল এনআইডি ব্যবহার করে গুলশানের একটি ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা লোন নেন। এ পর্যন্ত অর্ধশত জাল এনআইডিতে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার তথ্য পেয়েছে ডিবি।
গুলশান থানা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোমিন মিয়া গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিদ্ধার্থ ও আনোয়ারুল আমার অফিসেই কাজ করত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মিরপুর এলাকার এনাইডি জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। তাদের এই অপকর্ম সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।’
কর্তৃপক্ষ যা বলছে : সার্বিক এই পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিরপুরের ঘটনাটি শনিবার রাতে আমরা জেনেছি। এর সঙ্গে আমাদের যে দুজন কর্মীর জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে, তাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে আমাদের মধ্যে আর কেউ এ অপকর্মে জড়িত আছে কি না তা খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’ কুষ্টিয়ার ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওই বিষয়টি নিয়েও তদন্ত চলছে।’
চট্টগ্রামের ঘটনার বিষয়েও তদন্ত চলমান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি কাজ করছে। একটি কারিগরি তদন্ত কমিটিও কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে পৌঁছবে। আমরা এ অপরাধচক্রের মূল উৎপাটন করতে চাই।’
জানা যায়, দুই বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এনআইডি বিষয়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তা সমাধানের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে সুপারিশ করা হয়। এনআইডি উইং থেকে তখন কর্মীদের সবাইকে সতর্ক করে বলা হয়, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য কারো বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, সেবাপ্রার্থীকে হয়রানি বা সেবা প্রদানে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।