‘দাদা, আই হ্যাভ ইনফরমড দ্য বুথ…আমার কথা বললেই হবে! চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনার রেফারেন্স বললেই হবে।’ ৩০ মে সাবরিনা নিজের মুঠোফোন থেকে কিউট সুমন নামের একজনকে মেসেজ দিয়েছিলেন। ৩ জুন তিনি আরেকটি নম্বরে মেসেজ দিয়ে লিখেছেন, ‘আমার রেফারেন্স দিতে বলো। ডা. সাবরিনা, চেয়ারম্যান, জেকেজি হেলথ কেয়ার।’ গ্রেফতারের পর থেকে দফায় দফায় অপরাধ অস্বীকার করে যাচ্ছেন ডা. সাবরিনা। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জলজ্যান্ত প্রমাণ তার সামনে হাজিরের পরও তা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। কিছু সময় পরপরই তিনি কেঁদে কেঁদে বলছেন, তিনি একজন ক্যাডার কর্মকর্তা। তার সঙ্গে সঠিক আচরণ করা হচ্ছে না। তিনি অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন। তবে শিগগিরই সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন বলেছেন, ‘সাবরিনা তো দারুণ স্মার্ট। গ্রেফতারের আগেই মনে হয়ে তিনি কারও কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কীভাবে তদন্ত কর্মকর্তাকে মোকাবিলা করবেন। কীভাবে কতটুকু উত্তর দেবেন। কিছুটা চুপ থাকার পর ফের করোনা পরীক্ষা নিয়ে ভয়ংকর প্রতারণায় লিপ্ত প্রতিষ্ঠান জেকেজির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বরাবরই এড়িয়ে যাচ্ছেন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তবে নিজের রেখে দেওয়া প্রমাণ সামনে আনলেও তা আনঅফিশিয়াল বলে দাবি করছেন তিনি।’ এদিকে জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা প্রতারণার মামলা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সোমবার রাতে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয় এবং এখন ডিবি পুলিশ মামলাটি তদন্ত করবে বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে আরিফ-সাবরিনা গংয়ের অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করে ফেলেছি। বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তার জন্য যা অনেক কাজে লাগবে। যত কৌশলই করুন না কেন, নিজের অপরাধের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না ডা. সাবরিনা।’
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘আমরা শিগগিরই সাবরিনা ও আরিফকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করব। তবে এখন পর্যন্ত যেসব প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে, তাতে করে সাবরিনার পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর দুই দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে পুনরায় রিমান্ডের আবেদন করা হবে।’ জানা গেছে, করোনার পরীক্ষা নিয়ে কেলেঙ্কারির পর জেকেজি ও সাবরিনা-আরিফ দম্পতির গল্প এখন সবার মুখে মুখে। অতীতে তাদের ভয়ে মুখ না খুললেও এখন তাদের পরিচিতজনেরাই এখন নাম না প্রকাশের শর্তে নানা বিষয়ে মুখ খুলছেন। কীভাবে তারা বাগিয়ে নিয়েছেন বড় বড় কাজ, কীভাবে অফিস কিংবা সর্বত্র ক্ষমতার দাপট দেখাতেন এমন সবকিছু। জেকেজির লাইসেন্স না থাকার পরও বাগিয়ে নেন করোনা পরীক্ষার কাজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের অজানা অনেক কাহিনি।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গতকাল সকাল থেকেই ডিবি পুলিশ সাবরিনাকে তিন দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগকে অনিয়মের স্বর্গরাজ্য করে রেখেছিলেন এই সাবরিনা। আর ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন ‘ইউনিট প্রধান’ পদের একজন চিকিৎসক। সেই চিকিৎসকের ছত্রচ্ছায়াতেই অনিয়মের চূড়ায় উঠেছিলেন সাবরিনা। দিনের পর দিন কাজ না করেই নিতেন বেতন। সুনজরে ছিলেন বলে অনুপস্থিত থাকার পরও সাবরিনার নাম উঠে যেত হাজিরা খাতায়। এদিকে গ্রেফতারের পর বর্তমানে কারাগারে থাকা আরিফুল হক চৌধুরীর পুনরায় সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছে ডিবি। আগামীকাল এ বিষয়ে শুনানি হবে বলে নিশ্চিত করেছে আদালত সূত্র। সূত্র আরও বলছে, নিজেকে বাঁচাতে আরিফকে ডিভোর্স লেটার পাঠানো এবং অফিস আদেশ জারি করাও কৌশল হতে পারে সাবরিনার।
কারণ সাবরিনাকে সব সময় ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন আরিফ। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের (এনআইসিভিডি) এক চিকিৎসকের সঙ্গে পার্টনারশিপে ধানমন্ডিতে একটি ফাস্টফুড ও কফিশপ দিয়েছিলেন সাবরিনা। ওই চিকিৎসকের বাসায় মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন পার্টিতে অংশ নিতেন তিনি। এসব কিছু অজানা ছিল না তার স্বামী আরিফের। তবে হঠাৎ করেই তাদের ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরতে থাকে। হঠাৎ করেই ওই চিকিৎসকের সঙ্গে স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারছিলেন না আরিফ। ৪ জুন তিনি হাজির হন স্ত্রীর কর্মস্থল এনআইসিভিডিতে। সাবরিনাকে ওই চিকিৎসকের সঙ্গে তার অফিসে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেন আরিফ। তিনি তখন হামলে পড়েন ওই চিকিৎসকের ওপর। এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৩ জুন ওভাল গ্রুপের সিইও আরিফুল হক চৌধুরী একটি অফিস আদেশে (ওভাল গ্রুপ, জেকেজি, বুকিং বিডি) অফিস স্টাফদের এই বলে সতর্ক করেন, ‘ওভাল গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরী, প্রধান ভিজুয়ালাইজার ওভাল গ্রুপ হুমায়ুন কবির হিমু, জেকেজির প্রধান নার্স তানজিনা চৌধুরী ও প্রধান মেডিকেল স্টাফ শাম্মী ওয়াদুদের সঙ্গে কেউ কোনো ধরনের যোগাযোগ কিংবা ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারবেন না।’ অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ছাত্রাবস্থাতেই উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন সাবরিনা : কলেজ-জীবন থেকেই উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন সাবরিনা। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে দেশের বাইরে থাকার কারণে পাশ্চাত্য জীবন যাপনেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ২২ ব্যাচের এই ছাত্রী বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মেতে উঠতেন ডিসকো আর মদের আড্ডায়। রাত-বিরাতে তাদের সঙ্গে ছুটে যেতেন লং ড্রাইভে। একপর্যায়ে ছাত্রাবস্থাতেই বিয়ে করে ফেলেন তারই এক ডাক্তারি পড়ুয়া সহপাঠীকে। তবে বেশি দিন টেকেনি তাদের বিয়ে। উচ্চাভিলাষী সাবরিনা পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেন এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে। তবে সেখানেও থিতু হতে পারেননি তিনি। আরিফ চৌধুরীর কারণে সেই সুখের সংসারেও কিছুদিনের মধ্যে বিষাদ ভর করে। ওই ব্যবসায়ীকে ডিভোর্স দিয়ে আরিফকে বিয়ে করেন সাবরিনা। সুন্দরী সাবরিনার ওপর ভর করে ওভাল গ্রুপের মাধ্যমে একে একে বাগিয়ে নেন আরিফ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বড় বড় ইভেন্টের কাজ।
সাবরিনার ‘সিম’ কৌশল : দীর্ঘদিন ধরে ডা. সাবরিনা তার এক রোগীর নামে নিবন্ধিত একটি মোবাইল সিম ব্যবহার করে আসছেন, যা বড় ধরনের অপরাধ। পুলিশের ধারণা, কোনো অপরাধ করেও ডা. সাবরিনা সহজেই দায় এড়াতে পারবেন বলেই এই সিম ব্যবহার করতেন। তবে সাবরিনার দাবি, ওই সিম কার নামে নিবন্ধিত তা তিনি জানতেন না। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, দীর্ঘদিন ধরেই নম্বরটি সাবরিনা ব্যবহার করে আসছেন, যা তার নামে নিবন্ধিত নয়।
করোনা রিপোর্ট জালিয়াতি আরিফ-সাবরিনার : জেকেজি নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছে। একটি ল্যাপটপ থেকে গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার ফ্লোর থেকে এই মনগড়া করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মেইলে পাঠায় তারা। তাদের কার্যালয় থেকে জব্দ ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। জানা গেছে, জেকেজির টেস্টে জনপ্রতি নেওয়া হতো সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি ১০০ ডলার। এ হিসাবে করোনার টেস্ট-বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
আনন্দ ট্রিপের নামে হানিমুন ট্রিপ : সব সময়ই পাশ্চাত্য ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী সাবরিনা- এ কথা তার ঘনিষ্ঠজনদের অজানা নয়। করোনার ভুয়া প্রতিবেদন তৈরির বিষয়টি জেকেজির প্রায় সব কর্মীর কাছে ওপেন সিক্রেট ছিল। তারা যাতে বিষয়টি বাইরে প্রকাশ করে না দেন সে জন্য ভিন্ন কৌশল হাতে নেন ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করার পর এক দিন ?‘আনন্দ ট্রিপের’ নামে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে একজন নারী ও একজন পুরুষ কর্মীকে আলাদাভাবে পাঠানো হতো। এর নাম তারা দিয়েছিল ‘হানিমুন ট্রিপ’। মহাখালীতে তিতুমীর কলেজের মাঠে জেকেজি যে করোনা বুথ স্থাপন করেছিল, সেখানে প্রায় প্রতি রাতে মদের পার্টি বসত। জেকেজির কর্মীরা রাতভর সেখানে নাচানাচি করতেন।
নায়িকা হতে চেয়েছিলেন প্রতারক ডা. সাবরিনা : ডা. সাবরিনা ২০১৬ সালে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন পোর্টালে। সেখানে বলেছিলেন নিজের মনের অনেক কথা। বলেছিলেন, তিনি মূলত চিত্রনায়িকা হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবার ইচ্ছার কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। হয়েছেন চিকিৎসক। সুনামও কুড়িয়েছেন। তবুও রুপালি পর্দা এখনো তাকে টানে। এখনো সময় পেলে নাচ করেন। অংশ নেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়।
প্রসঙ্গত, জেকেজির ভুয়া করোনা টেস্টের মামলায় সাবরিনাসহ আরও সাতজন আসামি রয়েছেন। অন্যরা হলেন- সাবরিনার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী, আরিফুলের ভগ্নিপতি সাঈদ, কর্মকর্তা-কর্মচারী হুমায়ুন কবির, তানজিনা পাটোয়ারী, মামুন ও বিপ্লব। রবিবার সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের তেজগাঁও ডিভিশনে আনা হলে পরে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সোমবার ঢাকার একটি আদালত সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
: বাংলাদেশ প্রতিদিন