দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের সুখে থাকতে দেবে না দুদক’- গত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসে তিনি এ কথা বলেন । কিন্তু এ কথা শুধুই ‘কথার কথা’-তে পরিণত হয়েছে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের ক্ষেত্রে। টানা দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে নিজের ও স্ত্রী ফারহানা রহমান হ্যাপির নামে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। কিন্তু ‘অভিযোগ’ না থাকার অজুহাতে দুর্জয়ের সেই পাহাড়ের ‘নীরব দর্শকের’ ভূমিকা পালন করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়। ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পরেই হাতে যেন তিনি ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে যান। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা দুর্জয় প্রথমবার এমপি হওয়ার পরপরই বাড়তে থাকে আয় ও সম্পদ। রাতারাতি বনে যান একটি পাওয়ার প্লান্টের পরিচালক। আর আয়ও বেড়ে যায় আট গুণ।
দুর্জয় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় নিজেকে চেজ ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেজ পাওয়ার লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি যে হলফনামা দাখিল করেন, সেখানে তার পেশার বিবরণীতে পাওয়ার প্লান্টের পরিচালক পদটি ছিল না। সে সময় তিনি দু’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বলে উল্লেখ করেছিলেন। যার একটিতে তিনি নিজেকে চেজ ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অন্যটিতে ফুওয়াং ফুড অ্যান্ড বেভারেজের পরিচালক হিসেবে দাবি করেছিলেন। অর্থাৎ প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি বনে যান পাওয়ার প্লান্টের পরিচালক।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় তিনি বছরে আয় দেখিয়েছেন ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার ২শ টাকা। এক্ষেত্রে কৃষিখাত থেকে বছরে ৫২ হাজার ৮শ টাকা, পারিতোষিক ও ভাতাদি থেকে আয় ২৩ লাখ ৪২ হাজার ৪শ টাকা এবং মৎস্য চাষ থেকে আয় দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এই হলফনামা দেওয়ার পাঁচ বছর আগে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় বছরে আয় দেখিয়েছিলেন ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। যেখানে কৃষিখাতে ১ লাখ টাকা এবং ব্যবসা থেকে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা আয় ছিল তার।
অর্থাৎ প্রথমবার এমপি হওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যে তার বাৎসরিক আয় বাড়ে ৭ দশমিক ৬৮ গুণ।
এমপি হওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় দুর্জয়ের ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার বিষয়টি এখন মানিকগঞ্জ শহরের ‘টক অব দ্য টাউন’। কিন্তু দুর্জয়ের প্রতিপত্তি ও তার ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে কেউই মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুর্জয় বাহিনীর জমি দখলের বিষয়টি এখন মানিকগঞ্জ জুড়ে ‘ওপেন সিক্রেট’। দখল ভীতির কারণে জেলার বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ওই এলাকায় জমি কিনতে আসে না। সে কারণে জমি কেনাবেচাও খুবই কম। আর বাংলাদেশ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং সড়ক ও জনপথের মতো সংস্থার সরকারি জমি এবং নদীভাঙা সম্পদ, বাজার বা অন্যান্য খাস জমি দখলে নেওয়া তো এমপির লোকজনের ‘রোজকারের’ ঘটনা।
ভূমি অফিস ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, দুর্জয় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর শুধু দৌলতপুর এলাকাতেই শতাধিক একর খাস জমি দখল করে নিয়েছেন। উপজেলা সদরের খাল-নালা ভরাট করে তা পজেশন আকারে বিক্রি করার ঘটনাও ঘটিয়েছে এমপি দুর্জয়। দৌলতপুর বাজারে জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই সরকারি নালা দখল করে ভরাট হয়েছে, সেখানেই এখন গড়ে উঠেছে বড় আকারের মার্কেট।
জাফরগঞ্জ নৌবন্দর সংলগ্ন যেসব জায়গা জমি কয়েক বছর আগে যমুনাগর্ভে বিলীন হয়েছিল অদৃশ্য কাগজপত্রের সাহায্যে সেসব জায়গার মালিক সেজেছেন এমপি দুর্জয়ের চাচা টিপু। স্ট্যাম্পে লিখিত দেওয়ার মাধ্যমেই নদীর সেই জায়গা বেচাকেনাও করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জমি দখলের মহড়ায় যুক্ত আছেন এমপিপত্নী ফারহানা রহমান হ্যাপি। তরা-মুলজান শিল্পাঞ্চলের অনেক জায়গা জমি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হ্যাপীর নামে। তার নামে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন সড়ক ও জনপথের বহু দামী জায়গা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মূলজান এলাকায় এই জমিতেই হ্যাপির নামে দুর্জয় পরিবারের শপিং মল তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়। এমপির স্ত্রী হওয়ায় জমি পুনরুদ্ধারে অনেকটাই হতাশ সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
এছাড়া কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করারও অভিযোগ আছে হ্যাপির বিরুদ্ধে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মেগা ফিড কারখানার পেছনে অন্তত তিনটি স্পটে ফসলি জমি দখল করে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। সেই মাটি আনা-নেওয়ার কাজে ট্রাক চালিয়ে ক্ষতি করা হচ্ছে আশেপাশের ফসলি জমির।
স্ত্রীর নামে এত সম্পত্তি থাকলেও নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় স্ত্রী ফারহানা রহমান হ্যাপির নামে যথাযথ কোনো আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি দুর্জয়।
অভিযোগ আছে, অবৈধভাবে অর্জিত এই সম্পদ বিদেশে পাচার করে এ দম্পতি মালয়েশিয়ায় গড়েছেন ‘সেকেন্ড হোম’।
এত সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর ছেড়ে দেন এমপি দুর্জয়। অন্যদিকে তার নাম ব্যবহার করে কেউ যদি অন্যায় কাজ করে তাহলে তাদের নাম পরিচয় জানতে চান তিনি। অভিযোগ পেলে নিজেই ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার দাবি করেন।
দুর্জয় বলেন, আয়ের উৎস তো এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) দেখবে। এনবিআর দেখুক আয়ের উৎস, আয়ের টাকা কই গেল? আর মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের সূত্র সম্পর্কে জানতে চান।
এত সম্পদ আর দুর্নীতির অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলাই নেই দুর্নীতি দমন কমিশনে। কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর দুদক রাঘল-বোয়ালের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ক্যাসিনো কাণ্ডে দুদকের ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিতও হয়েছে। কিন্তু দুর্জয়ের বিষয়ে অজানা কারণে নিশ্চুপ হয়ে আছে দেশের দুর্নীতি দমনের সর্বোচ্চ সংস্থাটি।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে দুদকে কোনো মামলা নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিষয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সেগুলো কমিশন গোপনে যাচাইবাছাই করবে। অনুসন্ধানযোগ্য হলে দুদক অবশ্যই অনুসন্ধান করবে।
:বাংলানিউজ