প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলীয় সদস্যরা বলেছেন, সরকার বাজেটে মহামারি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। সরকারের নানামূখী পদক্ষেপের ফলে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং যথারীতি বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আগামী খাদ্য সংকটের আশংকা নেই বলেও তারা দাবি করেন।
এক সপ্তাহ মূলতবির মঙ্গলবার সকালে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্ব সংসদের মূলতবি অধিবেশন শুরু হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্পসংখ্যক সংসদ সদস্য অধিবেশনে যোগ দেন। প্রথমেই ঐতিহ্যবাহী ও দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বক্তব্য রাখেন।
এরপর প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে ওই আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, সরকারি দলের আমিরুল হক মিলন, উম্মে কুলসুম স্মৃতি ও মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম, বিএনপি’র মো. হারুনুর রশীদ এবং বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা ও জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক প্রস্তাবিত বাজেটকে গণমুখী ও উন্নয়নমুখী আখ্যায়িত করে বলেন, ১২টি বাজেট আমরা বাস্তবায়ন করেছি, সকল লক্ষ্য আমরা অর্জন করেছি। করোনার কারণে গত তিন মাস দেশের অর্থনৈতিক চাকা প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু করোনা চিরস্থায়ী হতে পারে না, এটা একদিন শেষ হবেই। তাই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করবো।
তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে অনেক সমালোচনা শুনছি। বাংলাদেশ ব্যাংক দৃঢ়ভাবেই বলেছে, ব্যাংকে তারল্যের কোন সঙ্কট নেই, ঘাটতি ৮৭ হাজার কোটি টাকা নিলে কোন অসুবিধা হবে না। তাই বাজেট বাস্তবায়ন কোন অসুবিধা হবে না। করোনার মধ্যেও আমাদের খাদ্যর কোন ঘাটতি নেই, বরং উদ্বৃত্ত বলে তিনি দাবি করেন।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, করোনা সঙ্কটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বাজেট দিয়ে জাতিকে গৌরবাম্বিত করেছেন। একটা অস্বাভাবিক অবস্থা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেট গতানুগতিক। বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কমানো হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় কারিগরী নয়, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ টিম দ্রুত তৈরি করতে হবে, সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা ধারে ঋণ নিয়ে ঘি খেতে চাই না। যারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে সেকেন্ড হোম করেছে, তাদের টাকা ফেরত আনতে হবে। করোনা পুষে রেখে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে না, দুর্নীতি পুষে রেখে উন্নতি হবে না। তাই দুনীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, বিশ্বের অর্থনীতি যখন বিপর্যয়ের মুখোমুখি, উন্নয়নখাত বিপর্যস্ত- তখন আমাদের প্রবৃদ্ধি নির্ভর বাজেট করা উচিত হয়নি। বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। করোনার মধ্যেও এম-১৯ মাস্কসহ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সংবিধান না পড়ে বাজেট প্রণয়ন করলে নানা ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কৃষিখাতে ভর্তুকি যাতে কৃষকরা পায় সেটা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় সমবায়ের মাধ্যমে করলে কৃষকরা উপকৃত হবে। করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার অনেক বেড়ে যাবে, সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
ডা. দীপু মনি ইন্টারনেট ও মোবাইলের ওপর আরোপিত চার্জ প্রত্যাহারের দাবী জানিয়ে বলেন, আমাদের অন-লাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় যেতে হবে। আর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া অনৈতিক বলেই আমি মনে করি। কথায় কথায় কোরআানের কথা বলা, আর এতিমের টাকা আত্মসাতৎকারী দন্ডিত আসামীর পক্ষে সাফাই গাওয়া- দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, প্রতি বাজেটের সময়ই বিএনপি ও কিছু প্রতিষ্ঠান পান্ডিত্য ফলাতে বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নের হার ৯৫-৯৬ ভাগ। উচ্চাভিলাষ না থাকলে অভিলাস পূরণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা থাকে না। সরকারের উচ্চাভিলাস ছিল বলেই প্রতিটি বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্ছ ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বিএনপির হরুনুর রশীদের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি র্কীভাবে বিরোধী দল হয়? সংসদে সাংবিধানিকভাবে বিরোধী দল একমাত্র জাতীয় পার্টি। উনারা সরকারি-বিরোধী নাকি জঙ্গীদের দল তা তাদের বোঝানো উচিত। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে তার ছেলেকে অপহরণ ও হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বাজেটকে ’আশাবাদী বাজেট’ হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে শক্তি আছে, এখনও মজবুত রয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চাঙ্গা হতে আরও ছয় মাস সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রদানের সমালোচনা করেন তিনি।
বিএনপির মো. হারুনুর রশীদ প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনা করে বলেন, এমন সময় করোনার আঘাত এসেছে একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতি ছিল মারাত্মক দূর্বল। চিকিৎসা ও খাদ্য এখন মূল চ্যালেঞ্জ। সুশাসন ও সমন্বয়ের খুবই অভাব রয়েছে। তবে সরকার যে বাজেট দিয়েছে, তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা আছে কি না সন্দেহ। করোনাউত্তর দেশের অর্থনীতিকে সামাল দিতে যে ধরণের বাজেট প্রণয়ণের দরকার ছিল, তা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
মির্জা আজম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু, এক অভীন্ন নাম। ৭১ বছর বয়সী আওয়ামী লীগকে ২৬ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা। আর ৪০ বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার জন্য ৪ হাজার ২৬৮ দিন কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমানরা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৯ বার হামলা করা হয়েছে। সকল মন্ত্রী-এমপিরা সততার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সহযেগিতা করলে দেশ কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।