আওয়ামীলীগের সহযোগী সংঘটন যুবলীগের কথিত নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) ২৯৭ কোটি এবং যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দুজনের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করেছে সংস্থাটি। শামীমের মামলায় তাঁর মা আয়েশা আক্তারকেও আসামি করা হয়েছে।
চলমান ‘শুদ্ধি অভিযানে’ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘ শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুরুর দিনই গ্রেপ্তার হন মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন জি কে শামীম। দুজনের বিরুদ্ধেই অস্ত্র, মাদক ও অর্থ পাচার আইনে আলাদা আলাদা মামলা করে র্যাব।
শামীম ও খালিদের বিরুদ্ধে দুদকের ঢাকা–১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে আজ সোমবার মামলা দুটি হয়েছে। দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দুদকের উপপপরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৮–১৯ করবর্ষে জি কে শামীম ৫০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। কিন্তু আয়কর রিটার্নে তিনি তাঁর স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ৪০ কোটি ২১ লাখ ৪০ হাজার ৭৪৪ টাকা। অনুসন্ধানের সময় পাওয়া রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুদক তাঁর আরও ৫০ কোটি টাকা অর্জনের বৈধ উৎস খুঁজে পায়নি।
একই করবর্ষে তিনি আয়কর নথিতে অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য দেখিয়েছেন ৩৮ কোটি ৬৮ লাখ ১ হাজার ৮৯ টাকা। কিন্তু কোম্পনিতে বিনিয়োগ, এফডিআর ও গাড়ি কেনা বাবদ ৩৬ কোটি ৩৫ লাখ ১৮ হাজার ৭১৯ টাকার কোনো বৈধ উৎস পায়নি দুদক।
কাগজপত্র অনুযায়ী জি কে শামীমের মা আয়েশা আক্তার জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানির ২০ শতাংশের মালিক। অথচ তাঁর আয়ের কোনো উৎস নেই। অনুসন্ধান করে দুদক বলেছে, জি কে শামীমই তাঁর মাকে প্রতিষ্ঠানের অংশীদার দেখিয়ে নিজের অবৈধ আয়কে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এজাহারে দুদক বলেছে, জি কে শামীমকে গ্রেপ্তারের সময় তাঁর অফিসে অভিযান চালিয়ে তাঁর মায়ের নামে ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকার এফডিআরের কাগজপত্র জব্দ করা হয়। ওই টাকার তথ্য জি কে শামীম বা তাঁর মায়ের আয়কর নথিতে দেখানো হয়নি। দুদক বলেছে, আয়েশা আক্তার তাঁর ছেলে জি কে শামীমের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ নিজ নামে রেখে শামীমকে অপরাধে সহায়তা করেছেন।
এ ছাড়া শামীমের কার্যালয়ে অভিযান চলার সময় ১ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার টাকা এবং ৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলারও জব্দ করে র্যাব। ওই টাকারও কোনো উৎস পায়নি দুদক। সব মিলিয়ে জি কে শামীমের ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫১ টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
শামীমের প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড বর্তমানে এককভাবে গণপূর্তের ১৩টি প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে। আবার যৌথভাবে আরও ৪২টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত, যা সারা দেশে চলমান অধিদপ্তরের মোট প্রকল্পের ২৮ শতাংশ। সব কটি প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ৪ হাজার ৬৪২ কোটি ২০ লাখ টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক দশকে শামীম গণপূর্তের বিপুল পরিমাণ কাজ করেছেন, যার পরিমাণ অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা। অভিজ্ঞ মহলের প্রশ্ন, বিপুল পরিমাণ কাজের মধ্যে জে কে শামীম আয়কর নথিতে এত অল্প আয় দেখালে তাঁর বাকি অর্থ কোথায় গেছে। শামীমের আর কোথাও সম্পদ আছে কি না, সেটা যাচাই–বাছাই হয়েছে কি না।
এ বিষয়ে এজাহারে দুদক কিছুটা পরিষ্কার করেছে। তারা বলেছে, জি কে শামীম অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশে ও বিদেশে নামে–বেনামে জমা রেখেছেন বলে তথ্য আছে। তদন্তের সময় এসব বিষয়ে পুরোপুরি যাচাই–বাছাই করা হবে।
এদিকে, কারাগারে আটক শামীম ও খালেদকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে জানিয়েছে দুদক। এরপর তাঁদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন জানাবে সংস্থাটি। আদালতের অনুমতি পেলে সুবিধাজনক সময়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানিয়েছে দুদক।
আরও মামলা হবে
দুদক সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করেই দুটি মামলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বেশ কিছু মামলা হতে যাচ্ছে।
৩০ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো–কাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করে। অনুসন্ধান দলের সদস্যরা গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম যাচাই–বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে। সংস্থার গোয়েন্দা শাখার পক্ষ থেকে এসব তথ্য যাচাই–বাছাই করা হয়। পাশাপাশি র্যাব ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানেরা দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে বিপুল পরিমাণ গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেন। সেসব তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে দুটি মামলা করছে সংস্থাটি।
দুদকের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, শুরুতে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হলেও তালিকা এখন অনেক বড়। এটা এখন প্রায় ১০০ জনের মতো দাঁড়িয়েছে। যুবলীগের সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ওই তালিকায় আছেন কি না, জানতে চাইলে সূত্রটি জানিয়েছে, ক্যাসিনো–কাণ্ডে যাঁদেরই নাম এসেছে, সবাই অনুসন্ধানের আওতায় আসবেন। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মচারী যাঁরা জড়িত, তাঁদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
গণপূর্তের সাবেক দুই প্রকৌলীকে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ
এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করেছে দুদক। সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাঁদের ২১ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পদের হিসাব দুদকে জমা দিতে বলা হয়েছে। এই দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে জি কে শামীমের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, এঁদের যোগসাজশেই গণপূর্তের বড় বড় কাজগুলো বাগিয়ে নিয়েছেন শামীম। বিনিময়ে তাঁরা পেয়েছেন বিপুল অর্থ।
প্রসঙ্গত, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে এর আগে দুদকে বেশ কয়েকটি অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ নথিভুক্তির মাধ্যমে তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল সংস্থাটি।
:প্রথম আলো