এরা সবাই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী

ক্যাসিনো পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতরা প্রায় সবাই যুবলীগ-আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী বলে দাবি করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে তারা বিভিন্ন সময় অন্যদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব দলের এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদে ছিলেন তারা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তাদের অবস্থান পাল্টাতে থাকেন। টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করে রোজগার করা কোটি কোটি টাকা দিয়ে প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন।

সূত্র জানায়, ঢাকায় ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত রাজধানীর সাত নেতা এসেছেন ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি (এরশাদ) থেকে। এদের হাত ধরেই প্রথমে মতিঝিলের ক্লাবপাড়া, পরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ক্যাসিনোর প্রসার ঘটে।

এই সাত জন হচ্ছেন: যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, সমবায় সম্পাদক জি কে শামীম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ (কালা ফিরোজ) এবং মোহামেডান ক্লাবের লোকমান হোসেন ভুইয়া। এর মধ্যে চারজনকে র্যাব গ্রেফতার করেছে, বাকিরা এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে। এছাড়া অপর নেতা হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এসেছেন যুবদল থেকে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) হয়ে আওয়ামী লীগে।

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট:

সম্রাটের রাজনীতি যুবলীগ থেকে শুরু হয়েছে বলে প্রচার হলেও এক সময় তিনি যুবদলের নেতাদের সঙ্গে চলতেন বলে জানা গেছে। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটের আদি বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায়। তাঁর বাবা চাকরি করতেন রাজউকে। যুবলীগে সম্রাটের রাজনীতি শুরু হয় ১৯৯১ সালে। তার আগে যুবদল নেতাদের সঙ্গে তাঁর চলাচল ছিল। মূলত রাজধানীর মতিঝিল থানার বিভিন্ন এলাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলোয় জুয়ার আসরকে ক্যাসিনোতে উন্নীত করার মূল উদ্যোক্তা হলেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট।

জি কে শামীম:

শুক্রবার রাজধানীর নিকেতনে ব্যবসায়িক কার্যালয় জি কে বিল্ডার্সে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি নগদ অর্থ, ১৬৫ কোটি টাকার বেশি এফডিআর এবং বিপুল মার্কিন ও সিঙ্গাপুরি ডলারসহ আটক করা হয় যুবলীগ নেতা জি কে শামিমকে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের (চরভুলুয়া গ্রামের) দক্ষিণপাড়ার মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে জি কে শামীম। শামীম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক বলে নিজেকে দাবি করতেন।

যদিও কেন্দ্রীয় যুবলীগ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, শামীম যুবলীগের কোন পদে নেই। পারিবারিক সূত্রে সে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিএনপির যুব সংগঠন যুবদল নেতা জি কে শামীম লেখাপড়া শেষে ঠিকাদারি শুরু করেন। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবদলের সহসম্পাদক এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার খুবই ঘনিষ্ঠ। ওই নেতার সুনজরের কারণে তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে গণপূর্ত ভবনের সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীনই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আধিপত্য ধরে রাখতে ভোল পাল্টিয়ে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিতে থাকেন।

শফিকুল আলম ফিরোজ:

ধানমন্ডির কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ বিএনপির এক নেতার ক্যাডার থেকে হয়ে যান আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। চার জনকে হত্যাসহ তাঁর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বের হয়ে আসছে। র্যাবের করা দুই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার বিকালে ফিরোজকে ঢাকার আদালতে পাঠায় ধানমন্ডি থানা পুলিশ। তিনি দুই মামলায় ৫ দিন করে মোট ১০ দিন রিমান্ডে আছেন। বর্তমানে ডিবি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ধানমন্ডির কলাবাগান ক্লাবের ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন শফিকুল আলম ফিরোজ। কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বায়রার সিনিয়র সহ-সভাপতি ফিরোজ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ফিরোজ কলাবাগানে ৩০ কাঠার জায়গা দখলে নিয়েছেন। পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নির্মাণ কাজ দুই বছর বন্ধ রাখেন ফিরোজ। পরে বোঝাপড়া হওয়ার পর নির্মাণ কাজ চালু হয়।

আরমান :

ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানের রাজনীতির সূচনা বিএনপি দিয়ে। নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসে লাগেজ ব্যবসা করতেন। আরমান একসময় বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ইকবালের যাতায়াত ছিল হাওয়া ভবনে। তাঁর মাধ্যমে আরমানও হাওয়া ভবনঘনিষ্ঠ হন। শামিল হন বিএনপির রাজনীতিতে। পদ-পদবি না থাকলেও হাওয়া ভবনঘনিষ্ঠ বলে মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। বিএনপি আমলেই আরমান ফকিরাপুলের কয়েকটি ক্লাবের জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে যুবলীগের মিছিলে অংশ নিতে শুরু করেন আরমান। ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন সম্রাটের। সম্রাট ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হলে সহ-সভাপতি করা হয় আরমানকে। সম্রাটের ক্যাসিনোর টাকার সংগ্রাহক তথা ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত আরমান। আরমান শত শত কোটি টাকার মালিক এখন। সিনেমা ব্যাবসায়ে তিনি ইতোমধ্যে ৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন।

কমিশনার সাঈদ :

মোমিনুল হক সাঈদ ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং মতিঝিল এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি হন বিএনপি নেতা লোকমান হোসেন ভুইয়া। এই লোকমান হোসেনের ক্যাডার হিসেবে বিএনপির রাজনীতিতে আগমন ঘটে সাঈদের। মতিঝিল এলাকার ভয়ংকর ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাঈদ হঠাত্ যুবলীগ হয়ে ওঠেন বিএনপি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পরপরই। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়ে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠেন তিনি। ঢাকার ক্যাসিনোজগতের অন্যতম হোতা তিনি। তাঁর নিয়ন্ত্রিত ওয়ান্ডার্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে নগদ ১০ লাখ টাকা জব্দ করেছে র্যাব। তিনি আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেরও সভাপতি। সাঈদ বর্তমানে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন।

খালেদ ভুঁইয়া :

সদ্য বহিষ্কৃত ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার রাজনীতির শুরু ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রবাজ ক্যাডার হিসেবে। ১৯৮৭ সালে খিলগাঁওয়ের কুখ্যাত সন্ত্রাসী মানিক ও মুরাদের মাধ্যমে ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ক্যাডার পরিচিতি পান। পরে সম্রাটের মাধ্যমে যোগ দেন যুবলীগে। যুবলীগে আসা খালেদের টার্গেটে পরিণত হন এলাকার নিবেদিত আওয়ামী পরিবারের সদস্যরা। মোহাম্মদপুরে যুবলীগ নেতা গিয়াসসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক নেতা খুনের পেছনে খালেদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

লোকমান হোসেন ভুইয়া:

গ্রেফতারকৃত বিসিবি পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভুইয়া এখনো বিএনপির রাজনীতি করলেও প্রকাশ্যে করেন আওয়ামী লীগ। বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু লোকমান। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির মধ্যসারির নেতা ছিলেন তিনি। মোহামেডান ক্লাবে ফালুকে সভাপতি করে লোকমানই জুয়ার আসর বসান।

শামশুল হক চৌধুরী:

জাতীয় সংসদের হুইপ চট্রগ্রামের পটিয়ার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী এক সময় ডবলমুরিং থানা যুবদলের সেক্রেটারি ছিলেন। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) রাজনীতিও করেছেন।ইত্তেফাক

Scroll to Top