সৃষ্টিজগৎ পরিচালনায় আল্লাহর নীতি

অনন্তকাল ধরে সৃষ্টিজগতের সব জীব ও জড় বস্তু একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে কালাতিক্রম করছে। জগতের এই শৃঙ্খলা রক্ষায় মহান স্রষ্টা আল্লাহর যে ইচ্ছাশক্তি কার্যকর রয়েছে, তাকেই মোটাদাগে সৃষ্টিজগৎ পরিচালনায় আল্লাহর নীতিমালা বলা যায়। কালাম (বিশ্বাস) শাস্ত্রবিদরা বলেন, সৃষ্টিজগতের ব্যাপারে আল্লাহর নীতিমালা হলো—সেই সব প্রাকৃতিক নিয়ম, যা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী সৃষ্টিজগৎ ও মানুষের জীবন পরিচালনা করে। সব কিছুকে গতিশীল, সুস্থির ও শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখে। জগতের কোনো কিছুই এই নিয়মের বাইরে নয়। তবে হ্যাঁ, ব্যক্তি, সমাজ, মানুষ ও পশুর জীবন ইত্যাদি বিষয়ে আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশনা ভিন্ন ভিন্ন। তাঁর চিরন্তন বিধান, আদেশ ও নির্দেশনা কখনো পরিবর্তনও হয় না এবং তা কার্যকর হতে বিলম্বও হয় না। সমগ্র সৃষ্টিজগতের ওপর একত্রে কার্যকর হয়। মানুষের জীবন, চালচলন ও লেনদেনে বরং সৃষ্টিজগতের ওপর তার প্রভাব দেখা যায়। এর ভিত্তিতে আল্লাহর সাহায্য লাভ, পরাজয়, শক্তি, দুর্বলতা, সম্মান, অসম্মান ইত্যাদি নির্ধারিত হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আল্লাহর বিধিতে কখনোই কোনো পরিবর্তন পাবেন না, আপনি আল্লাহর বিধিতে কখনোই কোনো ব্যতিক্রম পাবেন না।’ (সুরা : ফাতির,   আয়াত : ৪৩) সৃষ্টিজগৎ পরিচালনায় আল্লাহর নীতিমালা পর্যালোচনা করলে মৌলিক তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। তা হলো—স্থায়িত্ব, ব্যাপকতা ও অপ্রতিরোধ্য।

স্থায়িত্ব : আল্লাহ সৃষ্টিজগৎ পরিচালনায় যে নীতিমালা ও নিয়ম প্রণয়ন করেছেন তা স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। তা যেকোনো ধরনের পরিবর্তন ও বিকৃতি মুক্ত। সব ধরনের হস্তক্ষেপের ঊর্ধ্বে আল্লাহর এই বিধান। আল্লাহর নির্দেশ ও নির্দেশনাই মহাজগতের গতি, মানুষের জীবন, সভ্যতার পর্যায়ক্রমগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, সভ্যতার উত্থান ও পতনের কারণও ব্যাখ্যা করে আল্লাহর চিরন্তন এই বিধান। সুতরাং পৃথিবীর কোনো জড় ও জীব স্রষ্টার নিয়মের বাইরে চলতে পারে না।

ব্যাপকতা : আল্লাহর নীতি ও বিধি কার্যকরের ক্ষেত্রে সব জীব ও জড়, সব সৃষ্টি সমান। বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে সৃষ্টিগুলোর মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। কোনো কিছুই আল্লাহর নিয়মের বাইরে নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের ইচ্ছা ও আহলে কিতাবদের (খ্রিস্টান ও ইহুদি) ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু হবে না। যে কোনো মন্দ কাজ করবে, তার শাস্তি সে পাবে। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সে অভিভাবক ও সাহায্যকারী হিসেবে পাবে না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১২৩)

তবে কার্যকর হওয়ার দিক থেকে আল্লাহর সব নিয়ম সমান নয়। যেমন—সাহায্য প্রদানে আল্লাহর নিয়ম সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। আল্লাহর সাহায্য লাভের জন্য কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। যারা তা পূর্ণ করবে, শুধু তারাই তা লাভ করবে। যেমন—যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহ তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদেরই সাহায্য করেন; যদিও অবিশ্বাসীরাও আল্লাহর বান্দা।

অপ্রতিরোধ্য : আল্লাহর ইচ্ছা, নিয়ম ও বিধান অপ্রতিরোধ্য। যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যেকোনো ব্যক্তি বা বস্তুর বিরুদ্ধে আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণ কার্যকর। সৃষ্টিজগতের কেউ তা প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে না; বরং কেউ তা প্রতিহত করতে চাইলে তার পরাজয় সুনিশ্চিত। অতীতে বহু জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন, যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের পূর্বে বহু বিধান-ব্যবস্থা গত হয়েছে। সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যাশ্রয়ীদের কী পরিণাম।’  (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৭)

সৃষ্টিজগতে কার্যকর আল্লাহর কিছু কর্মনীতি শক্তির বিপরীতে মহাশক্তির উত্থান : সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মহান আল্লাহ রাজত্বকারী শক্তির বিরুদ্ধে মহাশক্তির উত্থান ঘটান, যাতে পৃথিবীতে ক্ষমতা, রাজত্ব ও মানবিকতায় ভারসাম্য রক্ষা পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি আল্লাহ মানুষকে পরস্পরের মাধ্যমে প্রতিহত না করতেন তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫১)

এই আয়াতের উদ্দেশ্য হলো, মানুষ ও পৃথিবীর শাসনব্যবস্থা কখনো একই অবস্থায় থাকে না। বরং তার পরিবর্তন হয় এবং শক্তির বিপরীতে মহাশক্তির উত্থান ঘটে। আল্লাহ তাআলা সেই উত্থান এমনভাবে ঘটান, যা মানুষের কল্পনাতীত এবং তা ধারাবাহিক।

সংস্কার ও পুনর্গঠন : আল্লাহ তাআলা প্রাকৃতিকভাবেই পৃথিবীর জলবায়ু, প্রকৃতি, মানবসভ্যতার সংস্কার ও পুনর্গঠন করেন। কোথাও কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে মহান আল্লাহ তাআলা তা কাটিয়ে ওঠা এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কুদরতি ব্যবস্থা রেখেছেন। মানবসমাজেও আল্লাহ সংস্কার ও পুনর্গঠনের ব্যবস্থা কার্যকর রেখেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কাজে আমি তোমাদের নিষেধ করেছি, সেই কাজে আমি তোমাদের অনুসরণ করতে চাই না। আমি তো আমার সাধ্যানুযায়ী সংশোধন (কল্যাণের পথে) কামনা করি।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৮৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আপনার প্রভু অন্যায়ভাবে কোনো জনপদ ধ্বংস করেন না। যে তার অধিবাসীরা কল্যাণের অনুসারী।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১৭)

পরিবর্তন : পুরো সৃষ্টিজগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের পেছনে তার কাজ ও কর্মপদ্ধতিই কার্যকারণ হিসেবে কাজ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থায় পরিবর্তন আনে।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ১১)

ন্যায়পরায়ণতা : আল্লাহ তাআলা সব সৃষ্টিকে উপযুক্ত কর্মফল দান করেন। ইহকাল ও পরকাল—উভয় জগতে সৃষ্টিজীবন কর্মের ফলাফল ভোগ করে ও করবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর বিচার ইনসাফপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কি মুসলিমদের প্রতি মুজরিমদের (অবাধ্য ও অপরাধী) মতো আচরণ করব?’ (সুরা : কলম, আয়াত : ৩৫)

সৃষ্টিজগৎ পরিচালনায় আল্লাহর নীতি ও চিরায়ত বিধান শতভাগ জানা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা থেকে যতটা জানা যায় তা আত্মস্থ করা মুমিনের জন্য কল্যাণকর, যেন তার জীবন আল্লাহর ইচ্ছার অনুকূলে পরিচালিত হয়।

Scroll to Top