চকচকে শরীর। কোথাও খুঁজেও এতটুকু ময়লা বের করা যাবে না। গায়ের রং সাদাকালো। নাম তার ‘টাইসন’। বিখ্যাত হেভিওয়েট বক্সার মাইক টাইসনের নামে তার এই নাম রাখা হয়েছে। শুধু কি নাম, তার হাবভাব যেন রাজা-বাদশার মতোই। এই টাইসন আর কেউ নয়, বিশালদেহী ফ্রিজিয়ান জাতের এক গরু। কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে তাকে।
রাজধানীর মোহাম্মপুরে অর্গানিক ডেইরি অ্যান্ড অ্যাগ্রোভেট খামারের ম্যানেজার আহাদ আহমেদ সানি গতকাল ইত্তেফাককে জানান, নিয়ম করে তিনবেলা গোসল করানো হয় টাইসনকে। খাবারও দেওয়া হয় তিনবেলা। বিশালদেহী টাইসনের ওজন ১ হাজার ২০০ কেজি বলে তিনি জানান। দাম হাঁকছেন ২০ লাখ টাকা!
তবে শুধু টাইসনই নয়, কোরবানির জন্য প্রস্তুত করতে সব পশুরই এখন যত্ন-আত্তির কমতি রাখা হচ্ছে না। এজন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন দেশের কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জের খামারিরা। আর মাত্র তিন সপ্তাহ পর কোরবানির ঈদ। খুব শিগগিরই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোরবানির পশু কেনাবেচার হাট বসা শুরু হবে। বলতে গেলে এখন চলছে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা। খামারিরা জানান, তাদের খামারে ৬০ হাজার টাকা দামের গরুও রয়েছে।
মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছর দেশীয় পশুতেই মিটবে কোরবানির চাহিদা। কারণ, চাহিদার চেয়ে কোরবানিযোগ্য পশু বেশি রয়েছে। বর্তমানে দেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ। এরমধ্যে ৪৫ লাখ ৮২ হাজার গরু-মহিষ, ৭২ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ৬ হাজার ৫৬৩টি অন্যান্য পশু। আসন্ন ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হতে পারে। এ হিসেবে ৮ লাখ পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। গত বছর কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখ পশু। আর গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেছেন, দেশে চাহিদার তুলনায় কোরবানিযোগ্য পশু বেশি রয়েছে। তাই দেশীয় পশুতেই এবার সব কোরবানি সম্ভব হবে। তিনি বলেন, দেশ মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর থেকে ভারতীয় গরুর অনুপ্রবেশ উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে। আগে প্রতিবছর ২৪ থেকে ২৫ লাখ ভারতীয় গরুর অনুপ্রবেশ ঘটলেও ২০১৮ সালে মাত্র ৯২ হাজার গরু দেশে ঢুকেছে। তিনি বলেন, এবার কোরবানির জন্য দেশের বাইরের গরু প্রয়োজন নেই। তাই খামারিদের স্বার্থে ঈদুল আজহা পর্যন্ত সীমান্তপথে বৈধ-অবৈধ সকল প্রকার গবাদিপশুর অনুপ্রবেশ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে খামারিরা বাইরে থেকে গরু আমদানি বন্ধে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এতে দেশের খামারিরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। তারা গবাদিপশুর ন্যায্যমূল্য পাবে। তাই কোনো অবস্থাতেই যেন বাইরে থেকে পশু না আসে।
জয়পুরহাটের তরুণ খামারি রিজন জানান, প্রতিবছরই গো-খাদ্যের দাম বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আনুষঙ্গিক খরচ। কিন্তু অনেক শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা গরুর খামার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছে। রিজন বলেন, গরু বিক্রির একটি বড়ো সময় কোরবানির ঈদ। এ সময় দেশে গরুর ব্যাপক চাহিদা থাকে। খামারিরা গরুর ন্যায্যমূল্য পেলে তারা আরো এগিয়ে যাবে। এবার ঈদে এই তরুণ উদ্যোক্তা তার খামারের ৪০টি গরু ঢাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাবেন বলে জানান। গরুর বেশি দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গো-খাদ্যের দাম বেশি। খাদ্যের দাম কমলে গরুর দামও কম হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খামারের কোরবানিযোগ্য এসব গরুর বেশিরভাগের বয়স ৩ থেকে ৪ বছর। খামারিরা এক-দুই বছর বয়সে এসব গরু কিনে আনেন। তারপর পরিচর্যা করে কোরবানির উপযোগী করে প্রস্তুত করেন। প্রাকৃতিকভাবেই তারা খামারে গরু মোটাতাজা করছেন। গরুকে কাঁচাঘাস, খড়, ভুসি, নানাজাতের ডাল, কুড়ার ভাতসহ আরো নানা ধরনের খাবার খাওয়ান।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদেক এগ্রো লিমিটেড এবার কোরবানির জন্য প্রায় ১ হাজার ৬০০ গরু প্রস্তুত করেছে। এরমধ্যে আলোচিত ব্রাহমা জাতের গরুও রয়েছে। আছে বিশাল আকারের মহিষ। এই খামারের তত্ত্বাবধায়ক মো. শরীফ ও আব্দুর রহিম জানান, নিয়ম অনুযায়ী খামারের গরুগুলোকে মোটাতাজা করা হয়। খাওয়ানো হয় পুষ্টিকর খাবার। এছাড়া খামারের ভেতর সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়, যাতে কোনো ধরনের রোগবালাই না হয়। তারা আশা করছেন, ঈদে তাদের খামারের সব গরু বিক্রি হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগেও দেশের কোরবানির হাটগুলো ভারতীয় গরু সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে এই নির্ভরতা কমতে কমতে এখন শূন্যের কোঠায়। গরু আমদানি কমে যাওয়ায় দেশি জাতের গরুর খামার করার হার বেড়ে গেছে। গরুর ভালো দাম পাওয়ায় অনেক বেকার তরুণ উদ্যোক্তা গরুর খামার গড়তে এগিয়ে এসেছেন। দেশে প্রতিবছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদিপশুর খামার বাড়ছে। বর্তমানে খামারের সংখ্যা ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪১৬টি। সবচেয়ে বেশি খামার রয়েছে চট্টগ্রামে। এছাড়া কুষ্টিয়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গবাদিপশুর খামার গড়ে উঠেছে।