শেয়ারবাজারে আরেকটি সম্ভাব্য ধসের শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। বাজারকেন্দ্রিক যতই প্রণোদনা দেওয়া হোক না কেন, বিনিয়োগকারীরা কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। অতীতে কয়েক দফা ধসের ধাক্কায় বাজারের প্রতি তাদের আস্থাহীনতা চরমে পৌঁছেছে। বাজারে টানা দরপতন যেমন চলছে, তেমনি সমানতালে চলছে বিক্ষোভ।
টানা দরপতনের প্রতিবাদে গতকাল মতিঝিলের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। এসময় তারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেনের পদত্যাগসহ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, দিনের শুরুতে গতকাল সোমবার সূচকের হঠাত্ উল্লম্ফন দেখা দেয়। তারপরই আবার নিম্নগতিতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। বাজারে গুজব রটে যায় যে কেলেংকারির নায়কেরা বাজারে সক্রিয় হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এসময় বিক্ষোভে নামেন।
শুরুতে বাড়লেও গতকাল টানা সপ্তম দিনের মত বড়ো দরপতন হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)। যা গত আড়াই বছরের মধ্যে সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান নিশ্চিত করেছে। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৮৮ পয়েন্ট। যা একদিনের হিসাবেও এবছরের সর্বোচ্চ পতন। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাজেটের পর থেকে শেয়ারবাজারে দরপতন চলছেই। কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিএসইসির ভূমিকা কাজে আসছে না। বাজারের এই দুর্দশা ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বিএসইসির প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, বাজারকে টেনে তোলার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দফতরের। কিন্তু বাজারের ক্রমদরপতনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না।
গতকাল ডিএসইতে মোট ৩৫২ টি কোম্পানির ১০ কোটি ৯৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৪৯ টি শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়েছে। মোট লেনদেনের পরিমাণ ৩০৬ কোটি ৬ লাখ ৯৯৫ টাকা। রবিবার লেনদেন হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকার। এভাবে টানা দর পতনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেন, ২০১০ সালে যে চক্র শেয়ারবাজার থেকে পরিকল্পিতভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল, সেই চক্রই আবার বাজারে সক্রিয় হয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবেই এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে। পাতানো খেলার মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম প্রভাব ফেলা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা ২০১০ সালের ‘রাঘববোয়ালদের’ আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে বলেন, তাদের শাস্তি দিতে পারলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘বিএসইসির এই চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে শেয়ারবাজার ভালো করা যাবে না। আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। এই চেয়ারম্যান ইস্যুয়ারের দালালি করছেন। বিনিয়োগকারীদের পক্ষে কোনো কাজ করছেন না।’
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গতকাল ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের কার্যদিবসের চেয়ে ৮৮ দশমিক শূন্য ১ পয়েন্ট কমে ৫০৯১ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট, ডিএস-৩০ মূল্য সূচক ৩৪ দশমিক ৭৬ পয়েন্ট কমে ১৮১৮ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট এবং ডিএসইএস শরীয়াহ সূচক ২৪ দশমিক ৩৮ পয়েন্ট কমে ১১৬৬ দশমিক ৩৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনকৃত কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৭ টির, কমেছে ৩০৩ টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১২ টি কোম্পানির শেয়ার।
লেনদেনের শীর্ষে ছিল, গ্রামীণ ফোন, মুন্নু সিরামিকস, ফরচুন সুজ, স্কয়ার ফার্মা, ইউনাইটেড পাওয়ার, জেএমআই সিরিঞ্জ, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, রানার অটো ও সিঙ্গার বিডি। দর বৃদ্ধির শীর্ষে প্রধান ১০টি কোম্পানি হলো, এসইএমএল এফবিএসএল গ্রোথ ফান্ড, ভ্যানগার্ড এএমএল রূপালি ব্যাংক ব্যালান্সড ফান্ড, ন্যাশনাল পলিমার, মতিন স্পিনিং, আইসিবি ৩য় এনআরবি মিউচ্যুয়াল ফান্ড, গ্ল্যাস্কো স্মিথ ক্লাইন, ট্রাস্ট ব্যাংক, ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, যমুনা ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লি.। অন্যদিকে দর কমার শীর্ষে প্রধান ১০টি কোম্পানি হলো, বিআইএফসি, মুন্নু সিরামিকস, প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং, এমারেল্ড অয়েল, এফএএস ফাইন্যান্স ও বিডি থাই।
অন্যদিকে দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএসইএক্স ১৫৭ পয়েন্ট কমে ৯ হাজার ৪৮৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে। সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট। লেনদেনে অংশ নেওয়া ২৭৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ৪০টির, কমেছে ২২০টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৮টির।
পিপলস লিজিংয়ের সঙ্গে লেনদেন না করার নির্দেশ
তালিকাভুক্ত কোম্পানি পিপলস লিজিং কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন না করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পিপলস লিজিংয়ের ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৭৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। গত ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের আবেদন করে। গত ২৬ জুন মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয়। গত ১০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক অবসায়নের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে।