দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়সারা তদন্তে পাটকলের নিরপরাধ শ্রমিক জাহালম ২৬ মামলার আসামি হন। দুদকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এই সত্যতা উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে যে ভুল হয়েছে, তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে।
আর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা এবং একাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা। তবে সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদ্ঘাটন করে আদালতের নিকট তা উপস্থাপন করাটা তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে মামলার অনুসন্ধান এবং তদন্তের পদ্ধতিগত সংস্কারের লক্ষ্যে ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। দুদকের কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান আদালতে এই রিপোর্ট দাখিল করেন।
জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ৩৩টি মামলা করে দুদক। ঐ সব মামলায় নিরপরাধ জাহালমকে মূল অপরাধী আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে আসামি করা হয়। পরে তিন বছর কারাভোগ করেন তিনি। গত ২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট কারাগারে থাকা জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে ২৬ মামলায় আসামি করার ঘটনায় কারা জড়িত, সে বিষয়ে দুদককে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। ঐ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন।
জাহালমের বাড়ি দেখলে মনে প্রশ্ন জাগত: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় করা মামলাগুলোর তদন্ত করেন দুদকের ১২ জন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের কেউই জাহালমের বাড়ি যাননি। তদন্তকালে আমি জাহালমের বাড়ি যাই। তার বাড়ির দৈন্যদশা খুবই প্রকট। যদি ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে থাকেন তাহলে তার বাড়ির এই দৈন্যদশা কেন? ঐ বাড়ি পরিদর্শন করলে আইওদের মনে সন্দেহ দেখা দিত।
অন্যের তদন্ত রিপোর্ট কপি করেছেন আইওরা: প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৩ মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা সিরিয়াস বা সঠিকভাবে মামলার তদন্ত করেননি। দুদকের কর্মকর্তারা প্রত্যেকেই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। প্রত্যেকেই আশায় ছিলেন, অন্যরা তদন্তে কোনো অগ্রগতি করলে তারা সেটি কপি করবেন এবং সেটিই তারা করেছেন।
এর মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন সেলিনা আখতার মনি। তিনিই আবু সালেককে শনাক্ত করার জন্য তৎপর ছিলেন। কিন্তু তিনিও কাজটি নিজে না করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দিয়ে সেটা করাতে চেয়েছিলেন। এখানে তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তার কোনো ভূমিকাই দেখা যাচ্ছে না। যিনি তদন্ত তদারক করছিলেন, ঐ কর্মকর্তাই এ ঘটনায় ৩৩টি মামলা দায়েরের সুপারিশ করেছিলেন। তার উচিত ছিল এই নবীন ও অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের গাইড করা।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের আসামি করা উচিত ছিল: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহালমের লেখাপড়া না জানা, তার সামাজিক অবস্থান ও আর্থিক সংগতি ঠিকমতো বিবেচনা করলে তিনি যে প্রকৃত আসামি নন, তখনই তা উদ্ঘাটিত হতো। আত্মসাৎকৃত ১৮ কোটি টাকা কোথায় গেল, তদন্তকারী কর্মকর্তারা সে বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেননি। এটা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের একটি ব্যর্থতা বা অযোগ্যতা ছিল।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত থাকলেও তাদের কাউকে আসামি করা হয়নি। কিন্তু তাদের দুদক আইনের ৫(২) ধারায় চার্জশিটভুক্ত করা উচিত ছিল। যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা জাহালমকে মূল অপরাধী আবু সালেক হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন, তাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।