স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত সাব্বির হোসেন নয়নকে খুঁজছে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডের পর নয়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে স্থানীয়রা। বেরিয়ে আসছে তার নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য। অভিযুক্ত সাব্বির হোসেন নয়ন বরগুনা পৌর শহরের বিকেবি রোডের শহরের ধানসিঁড়ি এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিকির ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, নয়নের কোনো রাজনৈতিক পদ-পদবি না থাকলেও নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা বলে পরিচয় দিতেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাবেক এমপি ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে ছাত্রলীগ নামধারী রিফাত ফরাজী ও রিশানের সঙ্গে নয়নের ছিল ঘনিষ্ঠতা। কখনো কখনো তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন নয়ন। এরপর মাদক ব্যবসার পাশাপাশি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন নয়ন। নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন বরগুনা পৌর শহরের অপরাধ জগতের। এরপরও বীরদর্পে ও সদলবলে এলাকায় চলাফেরা করতেন নয়ন।
দুই বছর আগে বরগুনা পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম নান্নাকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন নয়ন। এ ঘটনায় নান্না জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের কাছে বিচার দেন। তবে এ ঘটনায় তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাত শরীফকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন ও তার সহযোগীরা। হামলার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। ঘটনার পর আত্মগোপনে চলে যান নয়ন ও তার সহযোগীরা।
উল্লেখ্য, গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশাকে বরগুনা সরকারি কলেজে নিয়ে যান রিফাত। কলেজ থেকে ফেরার পথে মূল ফটকে নয়ন ও তার সহযোগীরা রিফাত শরীফের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে তারা। রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই হামলাকারীদের থামানো যায়নি। তারা রিফাত শরীফকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন রিফাত শরীফকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে রিফাত শরীফের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় বুধবার রাতে নিহত রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় বৃহস্পতিবার চন্দন, হাসান ও নাজমুল আহসান নামে তিন আসামিকে গ্রেপ্তারের কথা জাননিয়েছে পুলিশ। ওসি বলেন, হাসান মামলার ৯ নম্বর আসামি এবং চন্দন ৪ নম্বর আসামি। নাজমুলের নাম এজাহারে নেই।
বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নি হামলাকারী সবাইকে চিনতে না পারার কথা জানালেও নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর নাম বলেছেন।
দুই মাস আগে রিফাতকে বিয়ে করা মিন্নি সাংবাদিকদের বলেন, বিয়ের আগে থেকেই তাকে উত্ত্যক্ত করত, হুমকি দিতেন নয়ন। বিভিন্ন সময় পথেঘাটে হেনস্তাও করেছে।
বুধবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মিন্নি বলেন, আমি আর রিফাত কলেজ থেকে ফিরছিলাম। এ সময় কিছু ছেলে এসে রিফাতকে মারতে শুরু করে। আমি চেষ্টা করেও তাদের থামাতে পারি নাই। পরে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী আর রিশান ফরাজী এসে কোপানো শুরু করে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি; অস্ত্র ধরেছি; চিৎকার করছি; একটা লোকও আগায় আসেনি।
রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের আত্মীয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
আর নয়ন এক সময় রিফাতের বন্ধু ছিলেন বলে বরগুনার ওসি আবির হোসেন জানান। তিনি আগের দিনই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মিন্নিকে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করে আসছিলেন নয়ন। এই বিরোধকে কেন্দ্র করেই রিফাতের উপর হামলা হয়।
নয়নের মা শাহিদা বেগম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, তার ছেলের সঙ্গে গত বছরের অক্টোবরে ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে মিন্নির বিয়ে হয়। কিন্তু সেই বিয়ে ৩ মাসের মধ্যেই ভেঙে যায়। পরে নয়নের বন্ধু রিফাতের সঙ্গে মিন্নির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামের দুলাল শরীফের ছেলে রিফাতের সঙ্গে বরগুনা পৌর এলাকার নয়াকাটা এলাকার মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের মেয়ে মিন্নির বিয়ে হয় মাস দুই আগে।
লেটেস্টবিডিনিউজ/এনপিবি