তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ছবির পাশে শিরোনামটি ছিল: \’সাতটি দেশে বড় ব্যবধানে এগিয়ে\’। বিবিসির আরবি বিভাগ পরিচালিত যে জরিপটি গত মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে, সেটিকে এভাবেই প্রথম পাতায় তুলে ধরেছে তুরস্কের সরকার-পন্থী পত্রিকা আকসাম। যদিও তুরস্কে এরদোয়ানের দীর্ঘ শাসনামল বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে।
তবে বিবিসির এই জরিপ এরদোয়ানের সমর্থকদের জন্য কিছু সান্ত্বনা আনবে। কারণ তার একে পার্টি যখন ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে পরাজয়ের ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করছে, তখন আরব বিশ্বে তুরস্ক নেতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আরো ভালো খবর নিয়ে এসেছে এই জরিপ। এই জরিপে সবগুলো আরব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে এ পর্যন্ত পরিচালিত জরিপগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়।
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ফিলিস্তিনসহ ১০টি দেশে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের ওপর এ জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপে তাদের কাছে নানা বিষয়ের ওপর জানতে চাওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের শেষ দিকে থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের বসন্তকালে পর্যন্ত এ জরিপের সময়কাল ছিল।
আরব দেশগুলোর জনগণ আমেরিকা, রাশিয়া এবং তুরস্কের নেতাদের কতটা ইতিবাচকভাবে দেখে সে বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল জরিপে। ফলাফলে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান সবার নিচে এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দ্বিতীয় অবস্থানে।
কিন্তু তাদের দুইজনের সম্মিলিত গ্রহণযোগ্যতা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ধারের কাছেও নেই। ১১টি দেশের মধ্যে সাতটি দেশে ৫০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা এরদোয়ানের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। প্রথম দেখায় এটা স্বাভাবিক মনে হতে পারে যে, আরব দেশের মানুষ তাদের মতোই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরেকটি দেশ তুরস্কের নেতৃত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্ক এবং আরব- এ দুটো ভিন্ন জাতি। তাদের ভাষাও আলাদা। তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য কয়েক শ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার একটি বড় অংশ শাসন করেছে। সে সময় তারা আরব দেশের জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করেছে।
বর্তমানে আরব দেশগুলোর অন্যতম বিখ্যাত শহর হচ্ছে লেবাননের রাজধানী বৈরুত। এ জায়গাটির \’মার্টার্স স্কয়ার\’ বা \’শহীদ চত্বর\’ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তুরস্কের অটোম্যান শাসকদের দ্বারা আরব জাতীয়তাবাদীদের হত্যার স্মৃতি বহন করছে এই চত্বর। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পরও সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি।
অটোম্যান সাম্রাজ্যেরে ভস্ম থেকে জন্ম নিয়েছে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের। ইস্তাম্বুলে খিলাফত বিলুপ্ত করে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ বেছে নিয়েছে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র।
এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামপন্থীদের বড় ধাক্কা দিয়েছিল। নতুন তুরস্কের গোড়াপত্তনের পর আরবি বর্ণমালা উঠিয়ে দেয়া হয় এবং ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করা হয়।
এর মাধ্যমে তুরস্ক পাশ্চাত্য-মুখী হয়ে উঠার পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়।
তুরস্কের সেনাবাহিনী, যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় ছিল প্রতিশ্রুতি-বদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
ইসরায়েলের সাথে সে অঞ্চলে যৌথ সামরিক মহড়া করতো তুরস্ক। কিন্তু সেসব দিন এখন আর নেই।
২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয় আবারো ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
মুসলিম বিশ্বের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনরায় জাগিয়ে তোলেন তিনি।
তুরস্কের অর্থনীতির স্বার্থে আরব দেশগুলোর সাথে ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছে ছিল।
বর্তমান তুরস্কে দেশটির সেনাবাহিনী পুরোপুরি বেসামরিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রকাশ্যে আমেরিকার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে \’একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা\’ হিসেব টুইটারের মাধ্যমে উল্লেখ করেন এরদোয়ান।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। গাজাকে একটি \’উন্মুক্ত কারাগার\’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।
পর্যবেক্ষক মারওয়ান মুয়াশের মনে করেন, ইসরায়েলকে নিয়ে এরদোয়ানের এসব বক্তব্য ফিলিস্তিন এবং জর্ডানে তার ভক্ত বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এরদোয়ানকে দেখা হয় এমন এক ব্যক্তি হিসেবে যিনি ইসরায়েল এবং আমেরিকার সামনে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক এখন ভালো অবস্থানে নেই। এরদোয়ান এখন কর্তৃত্ববাদী পথ বেছে নিয়েছেন।’
তুরস্কের একজন বিশ্লেষক ফেহিম তাসতেকিন- যিনি মধ্যপ্রাচ্যে পড়াশুনা করেন- মনে করেন, ইসরায়েলের সাথে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের যে অচলাবস্থা সেটি বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও জটিল।
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে তুরস্ক এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরব দেশের জনগণ এবং তুরস্কের রাস্তায় এরদোয়ান আবির্ভূত হয়েছেন এমন একজন নেতা হিসেবে যিনি ইসরায়েলের সমালোচনা করেন।’ ‘কোনো পশ্চিমা নেতার মধ্যে তারা এ বিষয়টি লক্ষ্য করেন না’
এরদোয়ানের উঠে আসার গল্প তুরস্কের বহু মানুষকে আন্দোলিত করে। একটি ধার্মিক পরিবারে জন্ম নেয়া এরদোয়ান তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ শাসক গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং তুরস্কের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন।
ফেহিম তাসতেকিন বলছেন, ‘সুদানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের শাসনামলে দেশটি যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তখন দেশটিতে তুরস্ক বিনিয়োগ করেছিল। এ জন্য সুদানের মানুষ কৃতজ্ঞ।’
কিন্তু এই জরিপের ফলাফলের দিকে যদি গভীর মনোযোগ দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিশরের মানুষ তুরস্কের নেতৃত্বকে নিয়ে সন্দেহ করে। মিশরের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ এরদোয়ানের পক্ষে।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এবং তুরস্কের নেতা এরদোয়ানের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে এটি তারই প্রতিফলন।
আরব ব্যারোমিটারের সিনিয়র গবেষক মাইকেল রবিনস মনে করেন, ‘তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ব্যাপকভাবে কমে গেছে মিশর এবং লিবিয়ায়। এ দুটো দেশে ইসলামপন্থীদের বিপক্ষে মনোভাব তৈরি হয়েছে।’
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বেশ স্পষ্টভাবে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। হোসনি মোবারকের পতনের পর মিশরে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড।
এরদোয়ান ইসলামি ভাবধারায় উঠে এসেছেন। তার চিন্তাধারার সাথে মিলে যায় মিশরের নির্বাচনের ফলাফল। সে নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামপন্থী মুসলিম বাদ্রারহুড ক্ষমতায় আসে।
কিন্তু মোহাম্মদ মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল সিসি। তার সাথে এরদোয়ানের বৈরিতার কোনো পাল্টা জবাব ছাড়া শেষ হয়নি।
মাইকেল রবিনসন বলেন, ‘মিশরে সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে তুরস্কের নেতাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেজন্য মিশরে এরদোয়ানের খারাপ ফল হয়েছে জরিপে।’
‘মিশরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরদোয়ান পরিষ্কারভাবে একটি পক্ষ নিয়েছিলেন,’ বলেন ফেহিম তাসতেকিন। সেজন্য এরদোয়ান সম্পর্কে মিশরের মানুষের মতামত অনেক বেশি বিভক্ত।
শুধু মিশর এবং লিবিয়া নয়, ইরাকের ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে। গোষ্ঠী সংঘাতে বিপর্যস্ত ইরাক। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সুন্নি মুসলিমদের পক্ষ নিয়েছেন।
এ কথা মনে রাখা দরকার যে, একটা সময় পশ্চিমা দেশগুলো এরদোয়ান সম্পর্কে অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করতো। ২০১১ সালে যখন আরব বসন্তের সূচনা হয় তখন সে অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে উঁচু আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তুরস্ককে একটি \’মডেল দেশ\’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল।
সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করেছিল যে, তুরস্ক হচ্ছে একটি \’শক্তিশালী গণতন্ত্রের\’ দেশ যেখানে প্রকৃতপক্ষে একজন নির্বাচিত নেতা আছে। এ ছাড়া তুরস্কের অর্থনীতি সমগ্র আরব অর্থনীতির প্রায় অর্ধেকের সমান বলে মন্তব্য করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস।
কিন্তু আট বছর পর সে আশাবাদের সামন্য কিছু অবশিষ্ট আছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের সূচকে তুরস্কের অবস্থান ক্রমাগত নিচের দিকে যাচ্ছে। সম্প্রতি দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ টালমাটাল।
তুরস্কের গণতন্ত্রকে সামরিক বাহিনীর প্রভাবমুক্ত করার জন্য এক সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে যারা এরদোয়ানের প্রশংসা করতেন, তারা এখন এরদোয়ানের সমালোচনা করছেন।
পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় তুরস্কে বহু সাংবাদিককে কারাগারে যেতে হয়েছে।
‘আরব বিশ্ব এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ তারা অন্য কোনো মুসলিম নেতা দেখছেন না যিনি গণতন্ত্রের স্বপ্ন এবং ভালো ভবিষ্যতের মাধ্যমে তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন,’ বলছিলেন ফেহিম তাসতেকিন।
অধিকাংশ আরব এখনো এরদোয়ানের সাথে আছে। এ বিষয়টিকে \’মরিয়া হয়ে ওঠার প্রতীক\’ হিসেবে দেখছেন ফেহিম তাসতেকিন।
লেটেস্টবিডিনিউজ/এসকেবি