ভারতের লোকসভা নির্বাচনের বুথ ফেরত জরিপের (এক্সিট পোল) ফল নিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক বিতর্ক চরমে। প্রায় প্রতিটি বুথ ফেরত জরিপে নরেন্দ্র মোদী-র নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়ার পুর্বাভাস উঠে এসেছে। এসব জরিপ প্রত্যাখ্যান করে সব বিরোধী দলই মিথ্যা অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনের বুথ ফেরত জরিপের ফল কখনও সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে, আবার কখনও সঠিক পুর্বাভাস এসেছে। ফলে বিরোধীদের মতো অনেকেই বলছেন, জরিপে বিজেপির এগিয়ে থাকা ভুল প্রমাণিত হতে পারে।
১৯৫৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় লোকসভা নির্বাচনের সময় দেশটিতে প্রথম বুথ ফেরত জরিপ পরিচালনা করা হয়। এরপর প্রতি নির্বাচনেই এমন জরিপ হয়েছে। অতীতে এসব জরিপের ফল সঠিক ও ভুল প্রমাণিত হওয়ার নজির রয়েছে। তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীরা যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তা প্রায় নজিরবিহীন।
নির্বাচনের ফল সম্পর্কে পুর্বাভাস দেওয়া বিশ্বের যে কোনো দেশেই কঠিন। তবে ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে তা আরও কঠিন। বুথ ফেরত জরিপে মোদির নেতৃত্বধীন বিজেপির অনায়াস জয় ও বিরোধী কংগ্রেসের অনেক পিছিয়ে থাকার কথা উঠে এলেও এটাকে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে রাজি না অনেকেই। এক্ষেত্রে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কথা তুলে আনছেন অনেকে।
ব্রেক্সিট ও মার্কিন নির্বাচনে মূলধারা ও জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে যথাক্রমে ব্রেক্সিট বিরোধী ও হিলারি ক্লিনটনের জয়ের কথা উঠে এসেছিল। কিন্তু ঘটেছিল উল্টো। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনেও বুথ ফেরত জরিপ ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের নির্বাচনে অতীতের বুথ ফেরত জরিপ ও চূড়ান্ত ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুথ ফেরত জরিপ প্রায়ই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি যে ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না, তা কোনও বুথ ফেরত জরিপেই আভাস পাওয়া যায়নি। ২০০৯ সালেও যে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ক্ষমতায় ফিরতে পারবে, তাও উঠে আসেনি কোনও জরিপে। যদিও ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির জয়ের আভাস বুথ ফেরত জরিপে পাওয়া গেলেও ব্যবধান সঠিকভাবে উঠে আসেনি।
ভারতের বিখ্যাত সেফোলজিস্ট জয় ম্রুগ এই বিষয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছেন, “আগে বলুন জীবনে কতবার দেখেছেন আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল? তাও তো আবহবিদ্যায় যে পরিমাণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা, গাণিতিক মডেলিং বহু বছর ধরে হয়ে আসছে- তার ভগ্নাংশও কিন্তু ভোটের পূর্বাভাসে হয়নি। তার ওপর ভারতে ভোটারদের চরিত্র এত বৈচিত্র্যময় এবং সবচেয়ে বড় কথা এদেশে যে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ সিস্টেম চালু আছে তাতে কাজটা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
বিভিন্ন দলের শতকরা ভোটের হার সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারলেও তাতে কতগুলো আসন জুটবে সেটা হিসেবে করা কিন্তু খুব ঝুঁকির। একটা নাম্বার গেম, তার সঙ্গে আপনার অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিক জ্ঞান সব মিলিয়েই এটা করতে হয়, আর তাতে কিছু ভুলের সম্ভাবনা থেকেই যায়।”
বুথ ফেরত জরিপ ভুল প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হাজির করেছেন জার্মান রাষ্ট্র বিজ্ঞানী এলিজাবেথ নোয়েল-নিউম্যান। এই তত্ত্ব অনুসারে, সংখ্যা লঘিষ্ঠ মত ধারনকারীরা অনেক সময় ভয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করেন না। এর ফলে সঠিক ও জরিপের ফলে বড় ব্যবধান তৈরি হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব কীভাবে কাজ করতে পারে তা তুলে ধরেছেন লন্ডনের কিংস কলেজের প্রভাষক ও সমাজ বিজ্ঞানী কামিনী গুপ্তা।
তিনি লিখেছেন, বিজেপির নেতারা এবারের ভোটকে দেশপ্রেমের মানদণ্ড হিসেবে হাজির করেছে। যারা মোদি ও বিজেপিকে ভোট দেবে না তাদের দেশবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। এই মত অনেক বিজেপি নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ধারন করেন। ফলে জরিপে অংশগ্রহণকারী অনেকেই ভুল তথ্য দিতে পারেন।
কামিনী গুপ্তা আরও দুটি কারণ তুলে ধরেছেন। একটি হলো বিজেপি সমর্থকদের ব্যাপক প্রচারণা। ফলে তাদের বিরোধীরা আতঙ্কে নিজেদের মত হয়ত প্রকাশ করেনি। দ্বিতীয় কারণ হলো, কংগ্রেস সমর্থকদের নীরব থাকা। খবর বিবিসি।
বাংলাদেশ সময়ঃ ১৪৪৮ ঘণ্টা, ২২ মে, ২০১৯
লেটেস্টবিডিনিউজ/এসকেবি