রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায়, তার সবাই প্রায় পথচারী। সরকারি হিসাব মতে ২০১৮ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের সিংহভাগই ছিলেন পথচারী। ঢাকা মহানগর পুলিশও (ডিএমপি) বলছে একই কথা। পথচারীর হাঁটা বা রাস্তা পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে, এমন ৪৫টি পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে ডিএমপি। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টের কোথাও ফুটওভার ব্রিজ, কোথাও আন্ডারপাস, আবার কোথাও জেব্রা ক্রসিং নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
ডিএমপির চিহ্নিত করা দুর্ঘটনাপ্রবণ পয়েন্টগুলোর একটি কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের সামনের সড়ক। গত দুই সপ্তাহে রাস্তা পার হতে গিয়ে এখানে নিহত হয়েছেন দুই পথচারী। কয়েক দিন পর পরই এখানে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। একই অবস্থা রামপুরা এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কেও। এর বাইরে তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো ফ্যাক্টটির সামনে, কাকলী ও গুলশান-১ ক্রসিংয়েও প্রায়ই দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে পথচারী।
মেরুল বাড্ডার বৌদ্ধমন্দিরের সামনের সড়কটিও দুর্ঘটনাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনেও। এখানেই রাস্তা পার হতে গিয়ে গত মাসে বাসচাপায় নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। এর জেরে গত বছরের আগস্টের পর ফের দানা বেঁধে ওঠে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন।
ঢাকার আরেকটি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হলো কুড়িল চৌরাস্তা। সড়কটিতে সবসময় দ্রুতগতির যানবাহন চলাচল করে। ফলে রাস্তা পারাপারের সময় প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছেন পথচারীরা। একই অবস্থা হাউজ বিল্ডিংয়ের উত্তর পাশের সড়কেও। উত্তরা মডেল টাউনের ১০ নম্বর সেক্টর এলাকার আইইউবিএটি ক্যাম্পাসের সামনের সড়কটিকেও দুর্ঘটনাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ডিএমপি।
রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রাণহানি ঘটে জাহাঙ্গীর গেট এলাকায়ও। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনের সড়কটি আরো ঝুঁকিপ্রবণ। মিরপুর-১০-এর আইডিয়াল স্কুলের সামনের অংশটি দুর্ঘটনাপ্রবণ। গাবতলীর মাজার রোড ও গরুর হাট ক্রসিং এলাকায় কয়েকদিন পর পরই সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে গাজীপুরের কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডও। এর বাইরে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের সামনের সড়কটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ঢাকায় ৪৭৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৩৯ জন। ২০১৫ সালে ৪৮৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২২৯ জন। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ১২৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৩৭ ও আহত হন ৩৩৭ জন। ২০১৭ সালে ঢাকায় ২৬৩টি দুর্ঘটনা ঘটার তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। তাতে ২৭৬ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ৩৫৮ জন আহত হয়েছিলেন। সে বছর ১৪৫টি দুর্ঘটনায় বাসের সম্পৃক্ততা ছিল। ২০১৮ সালে ঢাকায় ২৮০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৬ জন নিহত ও আহত হন আরো ৫৩২ জন। এসব দুর্ঘটনার একটা বড় অংশ ঘটেছে এই ১৮টি পয়েন্টে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এসব এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের সুপারিশ করেছে ডিএমপি।
অন্যদিকে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই পথচারী নিহতের ঘটনা ঘটছে বিমানবন্দর ক্রসিংয়ে। বিজয় সরণি মোড়েও একই অবস্থা। এ রকম আরো পাঁচটি স্থানে জরুরি ভিত্তিতে আন্ডারপাস নির্মাণের সুপারিশ করেছে ডিএমপি। এগুলো হলো উত্তরা মডেল টাউনের ১০ নম্বর সেক্টর এলাকার আইইউবিএটি ক্যাম্পাসের সামনে, তালতলা, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও পূরবী সিনেমা হলের সামনে।
হাতিরঝিলসংলগ্ন পুলিশ প্লাজার সামনের সড়কটিও পথচারীদের জন্য মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১০০ মিটারের মধ্যে আন্ডারপাস থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহতের ঘটনা ঘটছে গাবতলী ক্রসিং এলাকায়। শান্তা ক্রসিং, বটতলা মোড়, মেরুল বাড্ডা ক্রসিং, লাভ রোড ক্রসিং, তিব্বত ক্রসিং, কামারপাড়া ক্রসিং, ১২ নম্বর সেক্টর ময়লার মোড়, ১০ নম্বর সেক্টরের ব্রিজ, হাউজ বিল্ডিং আলাওল এভিনিউ, ফার্মগেট পুলিশ বক্স থেকে কনকর্ড টাওয়ার, প্রতিরক্ষা ক্রসিং (মিরপুর রোড), সনি সিনেমা ক্রসিং, টেকনিক্যাল ক্রসিং, বঙ্গবন্ধু কলেজ (সিরামিক রোড), টিঅ্যান্ডটি ক্রসিং, প্রশিকা ক্রসিং ও গাবতলী ক্রসিংকে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকিপ্রবণ পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলোয় অতিসত্বর জেব্রা ক্রসিং দেয়ার সুপারিশ করেছে ডিএমপি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বলেন, রাজধানীর যেসব পয়েন্টে অতিমাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলো শনাক্ত করা হয়েছে। এখন এ পয়েন্টগুলোয় দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য কী করা যায়, তা ভেবে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশকিছু দুর্ঘটনাপ্রবণ পয়েন্টে জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের সুপারিশও করা হয়েছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
তবে শুধু অবকাঠামো নির্মাণ করলেই এসব এলাকায় দুর্ঘটনা কমবে না বলে মনে করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ঢাকায় কিন্তু অনেকগুলো ফুটওভার ব্রিজ আছে, যেগুলো ব্যবহার হয় না। এসব ফুটওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ। আন্ডারপাসগুলো পথচারীরা ব্যবহার করতে চায় না। কোথাও ব্যবহার অনুপযোগী হওয়া, কোথাও নিরাপত্তার অভাব, আবার কোথাও শুধু মানুষের অসচেতনতার কারণেও অনেক ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার হচ্ছে না। তাই শুধু অবকাঠামো বানালেই হবে না, সেগুলোয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা রাখতে হবে। এগুলো হতে হবে পথচারীবান্ধব। পাশাপাশি এসব অবকাঠামো ব্যবহারে মানুষকে সচেতন করতেও উদ্যোগী হতে হবে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষগুলোকে।