দাদির কবরের পাশে চিরনিদ্রায় নুসরাত

অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সন্ধ্যের দিকে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে, সোনাগাজী মোহাম্মদ ছাবের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রাফির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, রাফির বাবা এ কে মুসা মেয়ের জানাজা পড়ান।

আগে থেকেই জানানো হচ্ছিল, বৃহস্পতিবার বাদ আসর সোনাগাজী মো. ছাবের সরকারী পাইলট হাইস্কুল মাঠে নুসরাত জাহান রাফির জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাদির কবরের পাশে রাফিকে সমাহিত করা হবে বলেও জানানো হয়। তবে রাফির মরদেহ সেখানে পৌঁছাতে কিছুটা বিলম্ব হয়।

জানাজার কিছুক্ষণ আগে রাফির মরদেহ সেখানে পৌঁছায়। লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে তার মরদেহ পৌঁছানোর আগে থেকেই সেখানে এলাকার মানুষজন জমায়েত হয়ে ছিলেন। রাফির মরদেহ পৌঁছানোর পর সেখানে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

শত শত মানুষ রাফির জন্য হাহাকার করতে থাকেন। কান্নার রোল পড়ে যায় চারিদিকে। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে এলাকার মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ।

রাফির মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। তার ময়নাতদন্তের জন্য তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।

পাঁচ দিন ধরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন নুসরাত। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার নির্দেশ দিলেও শারীরিক অবস্থার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।

এর আগে, নুসরাতের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তার লাইফ সাপোর্ট তেমন কাজ করছে না বলে জানান চিকিৎসকরা। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক ও মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান প্রফেসর ডা. আবুল কালাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, নুসরাতের লাইফ সাপোর্ট তেমন কোনো কাজ করছে না। আমরা মেডিক্যাল বোর্ডের সব সদস্য আইসিইউয়ের ভেতরে রয়েছি। তার জানানোর একটু পরই নুসরাতকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফিকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে। এ ঘটনায় রাফির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।

সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের অনুসারীরা গত শনিবার নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখান থেকে ফেনী সদর হাসাপাতালে এবং পরে শনিবার রাতেই তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাতের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সোমবার তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।

গত ৬ এপ্রিল (শনিবার) সকালে রাফি আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান। এ সময় মাদ্রাসার এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে- এমন সংবাদ দিলে তিনি ওই বিল্ডিংয়ের চার তলায় যান। সেখানে মুখোশ পরা ৪-৫ জন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। রাফি অস্বীকৃতি জানালে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।

এদিকে, এ ঘটনায় মামলার প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলাসহ তিনজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার দুপুরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সরাফ উদ্দিন আহম্মেদ এ আদেশ দেন।

কোর্ট ইন্সপেক্টর গোলাম জিলানী জানান, মাদ্রাসাছাত্রীর গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় আটক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলার ৭ দিন, একই মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আবছার উদ্দিন ও সহপাঠী আরিফুল ইসলামের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন করেন আদালত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেন তাদের প্রত্যেকের ৭দিন করে রিমান্ড আবেদন করলে আদালত পৃথকভাবে এ আদেশ দেন। এর আগে, মঙ্গলবার একই আদালতে নুর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন ও শাহিদুল ইসলামের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। 

অন্যদিকে, মঙ্গলবার রাতে আটক অধ্যক্ষের শ্যালিকার মেয়ে উম্মে সুলতানা পপি ও মামলার এজহার নামীয় আসামি যোবায়ের হোসেনকে আদালতে তোলা হয়েছে। তাদেরও ৭দিন করে রিমান্ড আবেদন করেছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কামাল হোসেন।

Scroll to Top