যে ৪ কারণে নুসরাতের মৃত্যু

চিকিৎসকদের প্রাণান্ত চেষ্টায় মৃত্যু সঙ্গে লড়াই করে চলেই গেলো শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করায় ফেনীর সোনাগাজীতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। মেয়েটি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছে ৫ দিন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নুসরাতের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়েছেন চিকিৎসকরাও।

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘নুসরাতকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি নুসরাতকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ‘নুসরাতের শরীরের ৮৫ ভাগ মেজর বার্ন। এর মধ্যে ৬০ ভাগ গভীর পোড়া। তার শ্বাসতন্ত্র পোড়া ছিল। কেরোসিন নিজেই টক্সিক। এটা ফুসফুস এবং ব্রেনের কার্যক্ষমতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। এর চারটা কারণই তার মৃত্যুর প্রধান কারণ বলা যায়।’

তানভীর আহমেদ বলেন, ‘এমনিতে সুইসাইডাল বা হোমিসাইডাল দুইটার ক্ষেত্রেই ইনটেনসিভ থাকে। যেগুলো দুর্ঘটনাজনিত, সেগুলোতে কোনও উদ্দেশ্য থাকে না। সেগুলো দুর্ঘটনাবশতই হয়ে যায়। যেগুলো আত্মহত্যার, সেগুলোর ক্ষেত্রে সে নিজে চিন্তা করে যে, আমি কীভাবে পুড়লে মারা যাবো। আর যেগুলো খুনের বিষয় থাকে, সেখানে চিন্তা করে যে, কীভাবে পোড়ালে মারা যাবে; সে আর কিছু করতে পারবে না। সেই কারণে এই দুই ক্ষেত্রের দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ থাকে।’

ঢামেকের এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘নুসরাতের ঘটনাটি আত্মহত্যাজনিত বলে আমাদের মনে হয় না। কারণ, আমরা তাকে যেরকম দেখেছি এবং তার যে অবস্থা এতে করে এটাকে আমরা আত্মহত্যাজনিত কেস কোনোভাবেই বলবো না। তাছাড়া আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছেন। আমরাও যতটুকু শুনেছি, এটা কোনোভাবেই আত্মহত্যাজনিত কোনও ঘটনা ছিল বলে আমার মনে হয় না।’

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘৮৫ ভাগ বার্ন হওয়া রোগীর বডিতে অনেক রকম সমস্যা হয়। এই রোগীকে বাঁচানো খুব মুশকিল। আজকে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। এ ধরনের পেশেন্টের হঠাৎ মৃত্যু হয়। আমরা সিঙ্গাপুরে কথা বলেছিলাম, তারাও বলেছিল চান্স অব সারভাইবেল কম।’

উল্লেখ্য, শনিবার (৬ এপ্রিল) ফেনীর পৌর শহরের সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে গেলে আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রের ভিতর তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তার চিৎকারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন দ্রুত তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান। 

এদিকে এ ঘটনায়  করা মামলায় এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মাদরাসার কারান্তরীণ অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলাকে মাদরাসা থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ৭ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মাদরাসাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

পরিবারের অভিযোগ, মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। নুসরাত বিষয়টি বাসায় জানালে তার মা সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার প্রেক্ষিতে সোনাগাজী থানা পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে।

এরপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় সিরাজউদ্দৌলার লোকজন। কিন্তু নুসরাত অপারগতা প্রকাশ করেন। এ অবস্থায় আলিম পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে ভাই নোমান নুসরাতকে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। এরই মধ্যে গেল শনিবার দুর্বৃত্তদের আগুনে ঝলসে যায় নুসরাতের শরীর।

Scroll to Top